জুলাই বিপ্লবের পর বাংলাদেশের রাজনীতি: সংকট, ষড়যন্ত্র ও নতুন রাষ্ট্রগঠনের পথ

মো: আবু তাহের পাটোয়ারী:
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ মিলেই ভারতের শত বছরের ঔপনিবেশিক শোষণ-বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তি পায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পর বাঙালিদের প্রাপ্য রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও সাংস্কৃতিক মর্যাদা প্রদান না করে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী নিজেরাই হয়ে ওঠে নতুন শোষক। এই অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ জন্ম নেয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার-একটি শোষণমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র-বাস্তবে রূপ নেয়নি। ১৯৭২ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৯০ সালের গণআন্দোলন-প্রতিটি আন্দোলনই একসময় ব্যর্থতার গহ্বরে তলিয়ে গেছে, কারণ কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটানো হয়নি; ক্ষমতার চক্রে পুনরায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে পুরনো শোষক ও দুর্নীতিবাজ গোষ্ঠী।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানও ছিল সেই দীর্ঘ সংগ্রামেরই ধারাবাহিকতা-যেখানে কোনো একক রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ছিল না। এ বিজয় ছিল ছাত্র, তরুণ, শ্রমজীবী, মধ্যবিত্ত ও গ্রামীণ জনতার মিলিত রক্ত, ঘাম ও আত্মত্যাগের ফসল। জনগণ বিশ্বাস করেছিল, এবার নতুন বাংলাদেশ গড়ার এক সুবর্ণ সুযোগ এসেছে। নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়-রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, ও একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করা।

কিন্তু ইতিহাসের নিয়মেই দেখা গেল, এই বিজয়ের পরও পুরনো শত্রুরা চুপচাপ বসে থাকেনি। রাষ্ট্রযন্ত্রে ঢুকে পড়েছে সেই পুরনো চক্র-দলবাজ, দলকানা, চাটুকার ও দুর্বৃত্তরা। প্রশাসনের বহু স্তরে তারা আগের মতোই প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। তাদের লক্ষ্য স্পষ্ট-মৌলিক সংস্কার ব্যর্থ করে দেওয়া, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করা, জনগণের আস্থা ভেঙে দেওয়া এবং সুযোগ পেলেই ক্ষমতার পুরনো কাঠামো ফিরিয়ে আনা।

এই ষড়যন্ত্র কেবল দেশীয় নয়; এর পেছনে রয়েছে আন্তর্জাতিক স্বার্থগোষ্ঠীরও জটিল খেলা। বাংলাদেশের স্বাধীন নীতি, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং দুর্নীতি-সন্ত্রাসমুক্ত রাষ্ট্রের স্বপ্ন বহু বহুজাতিক অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক শক্তির জন্য অস্বস্তিকর। তারা চায় না বাংলাদেশে এমন এক সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক, যা দুর্নীতি দমন, সম্পদের সুষম বণ্টন ও সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণে আপসহীন হবে। তাই নানা কূটনৈতিক চাপ, অর্থনৈতিক অবরোধের হুমকি এবং গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দুর্বল করার চেষ্টা চলছে।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক শূন্যতার সংকট। জুলাই বিপ্লবের পর বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী বা এনসিপি কেউই এই শূন্যতা পূরণে জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারেনি। রাজনৈতিক নেতৃত্বের এই ব্যর্থতা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। চাঁদাবাজি, তোলা-বাজি, দখলবাজি ও সন্ত্রাস পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এতে মানুষের মনে আশঙ্কা জন্মেছে-এই ব্যর্থতা যদি দ্রুত কাটিয়ে উঠা না যায়, তবে জুলাই বিপ্লবের আশীর্বাদই একসময় বিষফোঁড়ায় পরিণত হতে পারে, ঠিক যেমনটি হয়েছিল স্বাধীনতার পর।

আজকের বাস্তবতা হলো-নির্বাচনের জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ এখনো সৃষ্টি হয়নি। গ্রামে-গঞ্জে রক্তাক্ত সংঘাত, প্রভাবশালী মহলের ত্রাস, আর্থিক অনিশ্চয়তা এবং প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বপূর্ণ আচরণ সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে রেখেছে। এই অবস্থায় নির্বাচন আয়োজন মানে হবে অপরাধীদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা তুলে দেওয়া। জনগণ তাই বলছে-প্রথমে সংস্কার, তারপর নির্বাচন।

সংস্কারের এই পথ কোনো ‘কসমেটিক চেঞ্জ’ দিয়ে সম্ভব নয়; প্রয়োজন হবে কাঠামোগত বিপ্লব। প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অর্থনৈতিক নীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসীদের সর্বাত্মক শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে অপসারণ করতে হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের মতো মৌলিক খাতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব সুস্পষ্ট করতে হবে। সেই সঙ্গে গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি-মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সংগঠিত হওয়ার অধিকার-নিশ্চিত করতে হবে।

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ মুহূর্তে যে পরীক্ষার মুখোমুখি, তা কেবল প্রশাসনিক নয়; এটি রাজনৈতিক ও নৈতিকও বটে। জনগণের আস্থা ধরে রাখতে হলে সরকারকে প্রথমেই প্রমাণ করতে হবে যে, তারা দলমুক্ত, স্বার্থমুক্ত, আপসহীন। আর এই প্রমাণের প্রথম ধাপ হবে রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে দুর্বৃত্ত ও চাটুকারদের উচ্ছেদ।

ইতিহাস সাক্ষী, যে জাতি বিজয়ের পর দুর্নীতিগ্রস্তদের শাস্তি দিতে ব্যর্থ হয়, সেই জাতি দ্রুতই আবার শোষণের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। ১৯৭১-এর পর যেমন হয়েছিল, জুলাই বিপ্লবের পর তেমনটি হতে দিলে এই রক্ত, এই ত্যাগ, এই স্বপ্ন সব বৃথা যাবে। তাই আজ সময় এসেছে-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায়, সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে, একটি ন্যায্য ও সুশাসিত বাংলাদেশ গড়ার।

জুলাই বিপ্লব কোনো রাজনৈতিক দলের সম্পত্তি নয়; এটি জনগণের, এটি শহীদদের, এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের। তাই এই বিপ্লবের স্বপ্ন পূরণে সবাইকে সতর্ক, ঐক্যবদ্ধ ও আপসহীন থাকতে হবে। যদি আমরা এই সুযোগ হারাই, তবে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।

লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক
সাপ্তাহিক নবজাগরণ