১৯৪৭:মুসলিম জাতির টিকে থাকার রক্তাক্ত বাঁক

মোঃ আবু তাহের পাটোয়ারী:
বাংলাদেশে আজও অনেকেই ১৯৪৭ সালের বাস্তবতা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। কেউ বলেন-এটি ব্রিটিশের খেলা,কেউ বলেন-এটি অসম্পূর্ণ স্বাধীনতা। কিন্তু এই সত্য উপেক্ষা করা যায় না যে, ১৯৪৭ ছিল মুসলিম জাতির বেঁচে থাকার, সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব রক্ষার,এবং রাজনৈতিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এক অমূল্য বাঁক।

হ্যাঁ,১৯৪৭ আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়নি-তখনও পাকিস্তান ছিল ডোমিনিয়ন, ব্রিটিশ শাসনের ছায়া রয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এটি দিয়েছিল আমাদের জন্য আলাদা ভূখণ্ড,আলাদা পতাকা, আলাদা সাংস্কৃতিক আশ্রয়স্থল-যেখানে মুসলিমরা নিজেদের ধর্ম পালন করতে পারে,আজান দিতে পারে, কোরবানি করতে পারে, এবং নিজের খাদ্যাভ্যাসকে আইনের ভয় ছাড়াই ধরে রাখতে পারে। এই ভূখণ্ড ছাড়া হয়তো আজ আমরা গরুর মাংস খেতে পারতাম না, ইসলামিক জীবনাচার বজায় রাখা হতো অপরাধ, এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু আধিপত্যে গিলে খাওয়া হতো।

রক্ত,অশ্রু ও নারীর চিৎকার
১৯৪৭-এর কয়েক মাস আগে ও পরে ভারতীয় হিন্দু ও শিখ উগ্রবাদীরা মুসলিমদের ওপর এমন নৃশংসতা চালায়, যা মানুষের কল্পনাকেও হার মানায়।
আনুমানিক ৭৫,০০০ থেকে ১,০০,০০০ মুসলিম নারী অপহৃত হন। তাদের অনেককে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়, কেউ কেউ দেহব্যবসায় বিক্রি হন, অনেকে জোরপূর্বক হিন্দু বা শিখ ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। নারীদের স্তন ও নাক কেটে ফেলা,শরীরে গরম লোহার ছ্যাঁকা, হিন্দু প্রতীক উল্কি, এমনকি গর্ভবতী নারীদের জোরপূর্বক গর্ভপাত করানো-এসব ছিল প্রতিদিনের বাস্তবতা।

শরণার্থী ট্রেনে হত্যাযজ্ঞ চলেছে অবাধে-শিশুদের মাথা কেটে ফেলা, নারীদের নগ্ন করে রাস্তায় ঘোরানো,অপমানের সীমা ছাড়ানো বর্বরতা।
জম্মুর গণহত্যা:রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মুসলিম নিধন
১৯৪৭ সালের নভেম্বর। ডোগরা শাসক মহারাজা হরি সিংহের সেনাবাহিনী, আরএসএস ও হিন্দু সভার আধাসামরিক বাহিনী মিলে প্রায় ২,৩৭,০০০ মুসলিমকে হত্যা করে। দ্য টাইমস, লন্ডন ১০ আগস্ট ১৯৪৮-এ লিখেছিল-

“এটি ছিল পরিকল্পিত নির্মূল অভিযান। যদি মুসলিমরা সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে না পালাত, সবাইকে হত্যা করা হতো।”

এর আগে জম্মুর জনসংখ্যার ৬১% মুসলিম ছিল; গণহত্যার পর তারা হয়ে যায় সংখ্যালঘু।
ভয়াবহ পরিসংখ্যান:
কাঠুয়া: ৮,০০০ মুসলিমের মধ্যে বেঁচে মাত্র ৪০ জন।
আখনূর:১৫,০০০ মুসলিমের মধ্যে জীবিত ১০০ জন।
সাম্বা:১৪,০০০ মুসলিম পুরুষ হত্যা, নারীরা অপহৃত।
এক ঘটনায় ২৫,০০০ মুসলিমকে পাকিস্তানে পাঠানোর কথা বলে সারিবদ্ধ করে মেশিনগান চালানো হয়: ১৯,৫০০ জনের মধ্যে বেঁচে ছিলেন মাত্র ২১৫ জন।

জাতিসংঘের ১৯৪৯ সালের রিপোর্ট বলছে-মহারাজা নিজ হাতে গুলি চালিয়েছিলেন এবং মুসলিম‘সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন’করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
ঐতিহাসিক স্বীকারোক্তি
মহাত্মা গান্ধী ২৫ ডিসেম্বর ১৯৪৭ তারিখে বলেন-
“জম্মুর হিন্দু ও শিখরা মুসলিমদের হত্যা করেছে। মহারাজা দায়ী… মুসলিম নারীদের অসম্মান করা হয়েছে।”

পন্ডিত নেহেরু ১৯৪৯ সালে প্যাটেলকে চিঠি লিখে জম্মুর ‘জোনাল গণভোট’-এর পেছনে হিন্দু রাজনীতির ষড়যন্ত্র স্বীকার করেন।
অপহৃত নারীদের উদ্ধারের অভিযান
১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান-ভারত চুক্তির মাধ্যমে অপহৃত নারীদের উদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ৬ ডিসেম্বর ১৯৪৭-২৭ এপ্রিল ১৯৪৮:ভারতীয় পাঞ্জাব থেকে ৭,৪২৫ মুসলিম নারী উদ্ধার। ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৫৭ পর্যন্ত উদ্ধারকৃত মোট সংখ্যা ২৫,৮৫৬ নারী ও শিশু।

যদি ১৯৪৭ না আসত?
তাহলে আজ বাংলাদেশ থাকত না,থাকত এক উপমহাদেশ যেখানে মুসলিমরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক-আজানকে বলা হতো ‘শব্দদূষণ’গরুর মাংস খাওয়া হতো অপরাধ,এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা চিরতরে আমাদের নাগালের বাইরে থাকত।

১৯৪৭ শুধু একটি বছর নয়-এটি আমাদের অস্তিত্বের শেকড়, রক্তে লেখা মুক্তির সনদ। যে জাতি এই ইতিহাস ভুলে যায়, তারা দ্বিতীয়বার দাসত্বে পড়তে দেরি করে না।

লেখক:সম্পাদক ও প্রকাশক
সাপ্তাহিক নবজাগরণ।