মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
ঊনবিংশ শতাব্দীর এক উসমানীয় খাতুনকে ঘিরে কল্পচিত্র যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
তিনি একদিকে পর্দানশীন,রাজপ্রাসাদের সৌন্দর্য ও সংস্কৃতির প্রতীক;অন্যদিকে তীর-ধনুক হাতে নিশানাভেদী যোদ্ধা,ঘোড়ার পিঠে ঝড়ের বেগে ছুটে চলা সেনানায়িকা।
তাদের শিক্ষার পরিধি বিস্ময়কর-আরবি,ফারসি,তুর্কি ছাড়াও গ্রিক-ল্যাটিন;গণিত,জ্যোতির্বিজ্ঞান,চিকিৎসা ও ক্যালিগ্রাফি পর্যন্ত। অন্যদিকে গৃহস্থালি দক্ষতাও সমানভাবে সমৃদ্ধ: সেলাই, রান্না,গান-বাদ্য, নৃত্য। অর্থাৎ উসমানীয় সমাজে নারী ছিলেন শক্তি ও সৌন্দর্যের সমন্বিত প্রতীক।
কিন্তু প্রশ্ন হলো-যে সাম্রাজ্যে নারী এমন বহুমাত্রিক ভূমিকা পালন করতে পারতেন, যে সাম্রাজ্য ১৩০০ সাল থেকে শুরু করে ছয় শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডে কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিল,সেটিই বা কেন ধীরে ধীরে অবক্ষয়ের পথে গিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে চূড়ান্ত পতনের মুখে পড়লো?
ছয়শ বছরের উত্থান
উসমানীয় সাম্রাজ্যের জন্ম হয় আনাতোলিয়ার একটি ক্ষুদ্র তুর্কি বেইলিক থেকে,১২৯৯ সালে উসমান প্রথমের হাত ধরে। ১৪৫৩ সালে সুলতান মেহমেদ ফাতিহ কনস্টান্টিনোপল দখল করলে সাম্রাজ্য প্রকৃত অর্থে বিশ্বশক্তির মর্যাদা অর্জন করে। ১৬শ শতকে সুলেমান দ্য ম্যাগনিফিসেন্টের আমলে এ সাম্রাজ্য ছিল বিশ্বের অন্যতম প্রধান শক্তি-তিন মহাদেশে বিস্তৃত ভূখণ্ড,শক্তিশালী নৌবাহিনী,জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদ ও প্রশাসনিক কাঠামো।
কিন্তু ১৯২২ সালে শেষ সুলতান মুহাম্মদ ষষ্ঠ ক্ষমতা হারিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। পরের বছর মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে জন্ম নেয় আধুনিক তুরস্ক প্রজাতন্ত্র। অর্থাৎ প্রায় ৬২৩ বছরের ইতিহাসে সাম্রাজ্যের পতন ঘটে।
পতনের বহুমাত্রিক কারণ সামরিক শক্তির ক্ষয়
জানিসারি বাহিনী একসময় ছিল ইউরোপের আতঙ্ক, কিন্তু পরবর্তীতে তারা রক্ষণশীল,দুর্নীতিগ্রস্ত ও প্রযুক্তিগতভাবে পিছিয়ে পড়ে। ইউরোপীয়রা আধুনিক কামান ও নৌবাহিনী গড়ে তুললেও উসমানীয় সেনারা পুরনো কৌশলেই আটকে ছিল।
অর্থনৈতিক পতন
সমুদ্রপথ আবিষ্কারের ফলে এশিয়া-ইউরোপ বাণিজ্য আর উসমানীয়দের হাত দিয়ে চলেনি। রাজস্ব কমে যায়,বিদেশি ঋণের উপর নির্ভরশীলতা বাড়ে। ১৮৭৫ সালে সাম্রাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে দেউলিয়া ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।
প্রশাসনিক দুর্নীতি
বৃহৎ সাম্রাজ্য চালাতে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। কিন্তু কর সংগ্রহে অনিয়ম,কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও প্রাদেশিক বিদ্রোহ প্রশাসনকে দুর্বল করে তোলে।
জাতীয়তাবাদী বিদ্রোহ
গ্রিস,সার্বিয়া,রোমানিয়া,বুলগেরিয়া একে একে স্বাধীনতা অর্জন করে।ফলে সাম্রাজ্যের ভূখণ্ড ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়।
সংস্কারের ব্যর্থত
টানজিমাত সংস্কার (১৮৩৯–১৮৭৬) শিক্ষা,আইন ও প্রশাসন আধুনিকায়নের উদ্দেশ্যে শুরু হলেও জনগণের আস্থা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। বরং অর্থনৈতিক বোঝা ও বিদেশি প্রভাব বাড়িয়ে দেয়।
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব
রক্ষণশীল গোষ্ঠী ও আধুনিকতাবাদীদের দ্বন্দ্ব সাম্রাজ্যের ঐক্য বিনষ্ট করে। ইয়ং টার্ক বিপ্লব (১৯০৮)সংবিধান ফিরিয়ে আনলেও রাজনৈতিক বিভাজন আরও তীব্র হয়।
আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও বিশ্বযুদ্ধ
ইউরোপীয় শক্তিরা উসমানীয় সাম্রাজ্যকে বলত “ইউরোপের অসুস্থ মানুষ”।প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পক্ষে যোগ দিয়ে সাম্রাজ্য চূড়ান্ত পরাজয়ের মুখে পড়ে। সেভর চুক্তি (১৯২০) সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন করে দেয়।
শিক্ষা-
উসমানীয় পতন আমাদের শেখায়:
প্রযুক্তি ও জ্ঞানে পিছিয়ে থাকলে সামরিক শক্তি টিকে না।
অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব রাজনৈতিক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়।
দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা সাম্রাজ্যের ভিতকে ধ্বংস করে।
জাতীয় আকাঙ্ক্ষাকে দমন করলে বিদ্রোহ অনিবার্য হয়।
আন্তর্জাতিক কূটনীতির খেলায় নিজস্ব কৌশল না থাকলে পরাশক্তির হাতে সাম্রাজ্য ভেঙে যায়।
উসমানীয় সাম্রাজ্যের ইতিহাস একদিকে জৌলুশপূর্ণ সভ্যতার, অন্যদিকে অবক্ষয়ের বেদনাময় কাহিনী।
ঊনবিংশ শতকের খাতুনের হাতে তরবারি ও সূঁচ-এই প্রতীকই সাম্রাজ্যের দ্বৈত চরিত্রের প্রতিচ্ছবি। শক্তি ও সৌন্দর্য থাকলেও সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারা, আধুনিকতা গ্রহণে অনীহা,আর অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও বহিঃশত্রুর চাপ-এসবের সমন্বিত ফল ছিল পতন।
আজও এ ইতিহাস আমাদের সতর্ক করে দেয়-যে জাতি জ্ঞান,প্রযুক্তি,অর্থনৈতিক স্থিতি ও ঐক্য হারায়,তার পতন অবশ্যম্ভাবী।
লেখক:মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক,নবজাগরণ-