মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থান কেবল একটি আন্দোলন নয়-এটি রক্তে লেখা মুক্তির অধ্যায়। ছাত্র-জনতার বুকের রক্তে সিঞ্চিত এই বিপ্লব রাষ্ট্রকে নতুন পথে নিয়ে এসেছে। অথচ সেই ইতিহাসই কাগজে-কলমে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কারণ-প্রশাসনের ভেতরে বসে থাকা কিছু আমলা ও সুবিধাভোগী গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে ইতিহাস আড়াল করতে চেয়েছিল।
আমলাতন্ত্রের ‘না’ বলার রাজনীতি
ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ইতিহাস ও বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ে জুলাই বিপ্লবের পূর্ণাঙ্গ অধ্যায় যুক্ত করার সরকারি সিদ্ধান্ত ছিল। শিক্ষা উপদেষ্টা, এনসিসি,এনসিটিবি-সব পক্ষই প্রস্তুত। সময়ও ছিল হাতে। তবু হঠাৎ বলা হলো-“সময় নেই।”
এই ‘না’উচ্চারণ করেছিলেন অপসারিত সচিব সিদ্দিক জুবায়ের। প্রশ্ন হচ্ছে-কোন সময়ের অভাব?হাতে যখন দেড় মাস সময় ছিল! আসল অভাব ছিল সদিচ্ছার, আর ছিল ভয়-জনগণের জাগরণে গড়া ইতিহাস পাঠ্যবইয়ে ঢুকলে পুরনো শাসকগোষ্ঠীর মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যাবে।
লুকানো হাত,লুকানো ষড়যন্ত্র
শুধু সচিবই নয়,কারিকুলাম উইংয়ের ভেতরে সক্রিয় ছিল দলীয় নিয়োগ পাওয়া একটি গোষ্ঠী, যাদের দায়িত্ব ছিল ইতিহাস বিকৃত করা। একদা কুখ্যাত রাখাল রাহা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিচয় বিকৃত করে,জাতীয় পতাকাকে বইয়ের পেছনে সরিয়ে দিয়ে, আওয়ামী লীগকে‘বৃহত্তম দল’আখ্যা দিয়ে বিতর্ক তৈরি করেছিলেন।
তার অনুসারীরা চাইছিল না কোনোভাবেই জুলাই বিপ্লব পাঠ্যবইয়ের আলোয় আসুক।
এমনকি ২০২২ সালের বিতর্কিত কারিকুলামের মূল পরিকল্পনাকারী জেসমিন রুমিসহ কিছু কর্মকর্তাকে বদলির প্রক্রিয়া আটকে দেওয়া হয়েছিল। যেন প্রমাণ হয়-রাষ্ট্র পরিবর্তন হলেও বাহাত্তরের আমলাতন্ত্রের শিকড় এখনো আমাদের গলায় পেঁচিয়ে আছে।
কেন ভয় জুলাইয়ের ইতিহাসে?
কারণ, জুলাই বিপ্লব শেখায়-
শাসক যখন স্বৈরাচারী হয়,ছাত্র-জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্র বদলে দিতে পারে। কোনো দল নয়,কোনো গোষ্ঠী নয়-জনগণই ইতিহাস রচনা করে।
ক্ষমতার অপব্যবহার যত গভীর হোক না কেন,একদিন তার পতন অবশ্যম্ভাবী।
এই সত্য যারা ভয় পায়,তারাই পাঠ্যবই থেকে জুলাইকে মুছে দিতে চেয়েছে। নতুন প্রজন্মের দায়িত্ব:ইতিহাস চেপে রাখা যায় না। যত বাঁধাই দাও,সত্য একদিন বেরিয়ে আসবেই। তাই এখন দরকার-
ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির সব বইয়ে পূর্ণাঙ্গ অধ্যায় যুক্ত করা।
গ্রাফিতি,ব্যঙ্গচিত্র,দেয়াললিখন-সবকিছু পাঠ্যবইয়ে আনা, যেন শিশুরা বুঝতে পারে কেমন করে গণজোয়ার স্বৈরাচারকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি থেকে দলীয় লবি ও ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করে সরিয়ে দেওয়া।
জুলাই বিপ্লবের ইতিহাসকে আটকে রাখা মানে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া। অপসারিত সচিব সিদ্দিক জুবায়ের হয়তো সময়ের অজুহাতে ইতিহাস আটকাতে চেয়েছিলেন,কিন্তু সময়ই তাকে সরিয়ে দিয়েছে।
আজ নতুন বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে আমাদের শপথ হোক-
ইতিহাস বিকৃতির দিন শেষ। সত্য, সংগ্রাম আর বিপ্লবের কাহিনীই হবে আগামী প্রজন্মের পাঠশালা।
“জুলাইয়ের শপথ”
রক্তে লেখা ইতিহাস,লুকানো যায় না,
দেয়াল ভাঙে দেয়াললিখন-
“গণমানুষ জাগে,স্বৈরাচার পালায়”-
এই মন্ত্র নতুন প্রজন্ম শিখুক।
বুকের ক্ষত,চোখের জল,পতাকার লাল,
জুলাইয়ের রোদে দাউদাউ আগুন,
অন্ধকার যত গভীর হোক না কেন
আলোর ইতিহাস থামানো যায় না কখনো।