অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন:১৭ আগস্ট ২০২৫
বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সংস্কার আন্দোলন দমন করতে লাঠিয়াল বাহিনী নামানোর ঘটনা শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, পুরো স্বাস্থ্যখাতকে নতুন করে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।অনুসন্ধানে উঠে এসেছে-হাসপাতালের ভেতরে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট বহু বছর ধরে প্রভাব বিস্তার করছে। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত আছেন হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা,প্রভাবশালী সরবরাহকারী ঠিকাদার, এমনকি স্থানীয় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বেড়ে ওঠা দালাল বাহিনী।
সিন্ডিকেটের মূল তিন স্তম্ভ
১. প্রশাসনিক স্তর
হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত কয়েকজন কর্মকর্তা বছরের পর বছর অনিয়মের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। অভিযোগ রয়েছে-
ডা.মো.আজিজুল হক (সহকারী পরিচালক,প্রশাসন):ওষুধ ও সরঞ্জাম ক্রয়ে একাধিকবার অতিরিক্ত বিলের অভিযোগ উঠলেও ব্যবস্থা নেননি।
এক্স-ডেপুটি ডিরেক্টর আবুল কালাম (বর্তমানে বদলি হওয়া): তার সময়েই সরবরাহকারী সিন্ডিকেটের শেকড় গেঁথে যায়।
২.ঠিকাদার ও সরবরাহকারী চক্র
হাসপাতালের কোটি কোটি টাকার সরবরাহ চুক্তি নিয়ন্ত্রণ করছে কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী। তাদের বিরুদ্ধে আছে নিম্নমানের সরঞ্জাম সরবরাহ ও ভুয়া বিলের অভিযোগ।
মেসার্স রহমান ট্রেডার্স (মালিক: মো. সেলিম রহমান): ওষুধ ও ডিসপোজেবল জিনিসপত্র সরবরাহ করে। গত তিন বছরে প্রায় ৪০ কোটি টাকার চুক্তি পেয়েছে।
জনতা কনস্ট্রাকশন (মালিক:আবদুল মান্নান ওরফে মান্নান কমিশনার):হাসপাতালের মেরামত ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে জড়িত। টেন্ডার ছাড়াই কাজ নেওয়ার প্রমাণ আছে।
৩. রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও লাঠিয়াল বাহিনী
স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা হাসপাতালকে নিজেদের অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্র বানিয়ে রেখেছে। এদের ছত্রছায়াতেই হাসপাতালের ভেতরে দালাল ও লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে উঠেছে।
স্থানীয় ছাত্র সংগঠনের সাবেক নেতা জসিম উদ্দিন (ডাকনাম জসিম মাস্তান):হাসপাতালের ভেতরে দালালি,চাঁদাবাজি ও বহিরাগত ভাড়া খাটানোর মূল হোতা। কয়েকজন সিন্ডিকেট সদস্য সরাসরি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকে,ফলে প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সাহস পায় না।
অর্থের অঙ্ক ও দুর্নীতি চক্র
হাসপাতালের ভেতরে গত তিন বছরে অনিয়মের কয়েকটি বড় দৃষ্টান্ত-ওষুধ ক্রয়ে অতিরিক্ত বিল:হিসাবরক্ষণ শাখার নথি অনুযায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজারমূল্যের চেয়ে গড়ে ২৫% বেশি দামে ওষুধ কেনা হয়েছে। এতে প্রায় ১০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে।
সরঞ্জাম সরবরাহে ভুয়া বিল: অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি ও বেডশিট সরবরাহের নামে অন্তত ৩ কোটি টাকার বিল পরিশোধ হয়েছে, অথচ সরঞ্জামের সঠিক ডেলিভারি পাওয়া যায়নি। খাবার সরবরাহ:রোগীদের জন্য বরাদ্দ খাবারের মান নিম্নমানের, অথচ কাগজে প্রতি রোগীর জন্য দিনে ১৮০ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। বাস্তবে ব্যয় হয়েছে সর্বোচ্চ ৭০ টাকা।
শিক্ষার্থীদের অবস্থান ও আন্দোলনকারীরা বলছেন-
“আমরা ডাক্তার হতে যাচ্ছি,অথচ আমাদের চোখের সামনেই এই দুর্নীতি হচ্ছে। যারা জনগণের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার কথা, তারা জনগণের টাকা লুট করছে। যখন আমরা সংস্কারের কথা বলছি, তখন আমাদের ভয় দেখাতে লাঠিয়াল বাহিনী ব্যবহার করছে।”
প্রশাসনের অবস্থান হাসপাতালের পরিচালক ডা.মো.ফারুক হোসেন নবজাগরণকে বলেন-
“আমাদের হাসপাতালে কোনো বাহিনী নেই। তবে কিছু বহিরাগত হয়তো গোলমাল করতে পারে। আন্দোলনকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমরা চেষ্টা করছি।”
তবে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন তুলেছেন,যদি প্রশাসন প্রকৃতপক্ষে নিরপেক্ষ হয়,তবে কেনো তারা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেয় না?
বৃহত্তর প্রেক্ষাপট:স্বাস্থ্য খাতের সংকট
দেশের স্বাস্থ্য খাতে প্রতি বছর সরকারি বাজেটের প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। এর মধ্যে প্রায় ৩০% অর্থ অপচয় বা দুর্নীতির মাধ্যমে নষ্ট হয় বলে টিআইবি অনুমান করেছে। সরকারি হাসপাতালের ভেতরে গড়ে ওঠা এই সিন্ডিকেট কেবল অর্থ লুট করে না, রোগীর জীবন নিয়ে ব্যবসা করে।
বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেলের সংস্কার আন্দোলনের উপর হামলার পরিকল্পনা কেবল একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং একটি বড় বাস্তবতার প্রতিফলন-স্বাস্থ্য খাত রাষ্ট্রযন্ত্রের গভীরে গজিয়ে ওঠা সিন্ডিকেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
এই সিন্ডিকেটকে ভাঙতে হলে কেবল প্রশাসনিক নির্দেশ নয়, বরং জনগণের জবাবদিহিতা ও শিক্ষার্থীদের মতো আন্দোলনের ধারাবাহিক চাপই হতে পারে একমাত্র সমাধান।