মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট জন্ম নিয়েছিল পাকিস্তান-দুই ডানা মেলে, একপাশে পশ্চিম পাকিস্তান আর অন্যপাশে পূর্ব পাকিস্তান। ভূগোলের অস্বাভাবিক দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও ধর্মীয় ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া দেশটি কিছুটা সময়ের জন্য হলেও ছিল কোটি মানুষের আশার প্রতীক। কিন্তু মাত্র ২৪ বছরের মাথায় দেশটি ভেঙে টুকরো হলো। সৃষ্টি হলো বাংলাদেশ।
প্রশ্ন হলো-এই ভাঙনের দায় কার?
পাকিস্তান আমলে উন্নয়ন-ভুলে যাওয়া সত্য
আমরা সাধারণত পাকিস্তানি শাসনকে দেখি কেবল দমন-পীড়নের চশমায়। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় খুঁজলে দেখা যায়,গভর্নর আব্দুল মোনেম খানের সময় পূর্ব পাকিস্তানে বাস্তব উন্নয়নের স্রোত বয়ে গিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, শিল্পকারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, ব্যাংক, হাসপাতাল থেকে শুরু করে সংসদ ভবন, বায়তুল মোকাররম, কমলাপুর রেলস্টেশন, সায়েন্স ল্যাব, কাপ্তাই বিদ্যুৎ-এমন শত শত প্রকল্প আজও দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তানি শাসনামলের সাক্ষী হয়ে।
আজকের দিনে যখন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে একটি সেতু বা একটি প্রকল্প শেষ হতে দেড় যুগ লাগে, তখন প্রশ্ন করতেই হয়-পাকিস্তানি আমলে টেন্ডারবাজি, লুটপাট, টাকা পাচার না থাকায় উন্নয়ন কীভাবে “টাকার বরকতে” সফল হয়েছিল?
তাহলে ভাঙন কেন এলো?
এখানেই শুরু হয় রাজনৈতিক কূটচাল।
পশ্চিম পাকিস্তান চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানকে কেবল কাঁচামালের যোগানদাতা বানিয়ে রাখতে।
ক্ষমতার কেন্দ্রে সবসময়ই বঞ্চিত ছিল পূর্ব পাকিস্তান।
শেখ মুজিবের ৬ দফা দাবি সেই বৈষম্যের প্রতিবাদে উঠে এসেছিল।
কিন্তু ভারতের ভূমিকাও কম ছিল না। ১৯৭১ সালে ভারতীয় স্বার্থ ছিল স্পষ্ট-পাকিস্তানকে দুর্বল করে ভৌগোলিক রাজনীতিতে সুবিধা নেওয়া। আমেরিকা-পাকিস্তান-চীন ঘনিষ্ঠতার প্রেক্ষাপটে ভারত সুযোগ দেখেছিল পাকিস্তানকে ভাগ করার।
ভারত শুধু ঘি ঢেলেছিল না,পুরো আগুনটাই জ্বালিয়ে দিয়েছিল। প্রশিক্ষণ শিবির, মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা, সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ-সবই সেই বৃহৎ ভূ-রাজনীতির অংশ।
দায়ী কারা?
১. পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী-যারা বৈষম্য, ভাষা দমন ও রাজনৈতিক দমন চালিয়েছিল।
২. ভারতীয় নীতি-নির্ধারকরা-যারা পাকিস্তানের ভাঙনকে নিজেদের কৌশলগত জয় মনে করেছিল।
৩. আন্তর্জাতিক পরাশক্তির খেলা-শীতল যুদ্ধের দাবার ছকে পাকিস্তানকে ব্যবহার করেছিল আমেরিকা ও চীন, আর ভারতে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন।
৪. বাংলার রাজনীতিকেরা-যারা একতাবদ্ধ থেকে সমাধান খুঁজে বের না করে পরস্পরকে সন্দেহ ও ক্ষমতার লড়াইয়ে নিমগ্ন ছিলেন।
যদি পাকিস্তান না ভাঙত?
আজকের দিনে ২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে ভাবুন-যদি পাকিস্তান অটুট থাকত, তবে কেমন হতো?
২৪ কোটি জনসংখ্যার পাকিস্তানের সাথে যোগ হতো বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ। মিলিয়ে ৪১ কোটির একটি সুপার-পাওয়ার মুসলিম দেশ দাঁড়িয়ে যেত এশিয়ার মানচিত্রে।
অর্থনীতি, বন্দর, কৃষি, গার্মেন্টস, প্রযুক্তি-সব মিলিয়ে এ দেশ হতো বিশ্বে অন্যতম শক্তিধর ব্লক।
ভারত কখনোই দক্ষিণ এশিয়ার “একক পরাশক্তি” হয়ে উঠতে পারত না। মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বে পাকিস্তান-বাংলাদেশের ঐক্য আজ সৌদি আরবকেও ছাড়িয়ে যেত।
কিন্তু ইতিহাস অন্য কথা বলে। আমরা ভেঙেছি, ভারত জিতেছে। পাকিস্তান ভেঙেছে, আর বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে-বেদনাময় সত্যের সাথে গৌরবও জড়িয়ে আছে।
কার লাভ, কার ক্ষতি?
ভারতের লাভ: পাকিস্তানকে দুই টুকরো করা, কাশ্মীর প্রশ্নে কূটনৈতিক সুবিধা পাওয়া, এবং দক্ষিণ এশিয়ায় একক শক্তি হিসেবে টিকে থাকা।
পাকিস্তানের ক্ষতি: পূর্ব পাকিস্তান হারানো, ভৌগোলিক অখণ্ডতা ভেঙে যাওয়া, স্থায়ী দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া।
বাংলাদেশের ক্ষতি-লাভ: স্বাধীনতা পাওয়া নিঃসন্দেহে মহান অর্জন। কিন্তু অদ্যাবধি দুর্নীতি, রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, অকার্যকর প্রতিষ্ঠান-সব মিলিয়ে প্রকৃত উন্নয়ন কি সেই ত্যাগের সাথে সাযুজ্যপূর্ণ? এ প্রশ্ন এখনো আমাদের তাড়া করে ফেরে।
হানাদার পাকিস্তানি সেনারা আমাদের উপর অন্যায় করেছে-এ সত্য অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু উন্নয়ন-অর্জনের ইতিহাসও মুছে ফেলা যায় না। আমরা যেমন “দখলদারের অপরাধ” মনে রাখি, তেমনি “উন্নয়নের সত্য”ও স্বীকার করা প্রয়োজন।
সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো-যারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না, তারা বারবার একই ভুল করে। আজও বাংলাদেশ দুর্নীতি, লুটপাট, বিদেশমুখী রাজনীতি, এবং দমননীতির দুষ্টচক্রে আবদ্ধ।
প্রশ্ন রয়ে গেল-১৯৭১ সালে আমরা রক্ত দিয়ে দেশ পেলাম, কিন্তু ২০২৫ সালে এসে কি আমরা সেই রক্তের মর্যাদা রাখতে পেরেছি??
যুদ্ধ কারা বাধালো,খেসারত দিল কারা?
এই কবিতাটা
চৌদ্দ আগস্টে জন্ম নিল এক দেশ,
দুই ডানা মেলে-পূর্বে আর পশ্চিমে শেষ।
কিন্তু চব্বিশ বছরের মাথায় সে ভাঙন,
রক্তে ভিজে উঠল বাংলার প্রাঙ্গণ।
পশ্চিমের শাসন,বৈষম্যের জাল,
ভাষার দমন,রাজনীতির কাল।
ভারত দিল আগুনে ঘি,
পরাশক্তির দাবায় গুটি হলো নিরবধি।
গড়া হলো সংসদ ভবন, বায়তুল মোকাররম,
কাপ্তাই বিদ্যুৎ, কমলাপুরের ভোরবেলা ধ্বনিমধুর অনুরণন।
তবু বঞ্চনার তীব্র আঁচ,
বাংলার বুক জুড়ে জেগে উঠল হাহাকার আর কাচ।
যদি ভাঙত না পাকিস্তান,
হতো একাত্তরের গল্প অন্য গান-
চল্লিশ কোটির মুসলিম পরাশক্তি,
ভারতের কূটচাল পেত না দৃপ্তি।
আজ প্রশ্ন জাগে বুকের মাঝে,
স্বাধীনতার মশাল কি জ্বলছে সাজে?
রক্তে পাওয়া এই স্বদেশভূমি-
আমরা কি রাখলাম তার মর্যাদা,তার পূর্ণ রূপরাশি?
www.thenabajagaran.com