মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
১৬ থেকে ১৮ শতকের বাংলা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী, সমৃদ্ধ এবং শিল্পনির্ভর অঞ্চল। ইউরোপীয় বণিকরা একে ডাকত “Paradise of Nations”-জাতিগণের স্বর্গ। ঢাকার লালবাগ থেকে মুর্শিদাবাদের নবাবি ঐশ্বর্য, চট্টগ্রামের সমুদ্রবন্দর-সবকিছুই এই সুবর্ণ বাংলার চিহ্ন। তবে ইতিহাসের গভীরে,মেঘনা-পদ্মা-ডাকাতিয়া নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে ছিল নোয়াখালী (তৎকালীন ভূলুয়া-স্বন্দ্বীপ)। সমুদ্র ও নদীর মেলবন্ধন, চর ও বিলের সংযোগ এই অঞ্চলকে বানিয়েছিল কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
নোয়াখালীতে উর্বর পদ্মা-মেঘনা পলিমাটি গড়ে তুলেছিল সমৃদ্ধ কৃষি সমাজ। ধান, আখ, পাট, নারিকেল, মাছ, পান ও সুপারির প্রাচুর্য নিশ্চিত করত খাদ্য নিরাপত্তা এবং বাণিজ্যিক সম্ভাবনা। নদীপথের কারণে নোয়াখালী ছিল মুঘল ও ইউরোপীয় বণিকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ লজিস্টিক কেন্দ্র। চট্টগ্রাম-স্বন্দ্বীপ অঞ্চলে নির্মিত জাহাজসমূহ শুধু স্থানীয় যুদ্ধ বা বাণিজ্য ব্যবহারে নয়, ইউরোপ পর্যন্ত রপ্তানি হতো। ফরাসি ভ্রমণকারী ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ার লিখেছিলেন, নোয়াখালীতে নির্মিত জাহাজের মান ও কারুকাজ এত উঁচু যে, তা সমগ্র বঙ্গ ও ভারতের অন্যান্য অংশের সাথে তুলনীয়।
শিল্প ও কারুশিল্পও নোয়াখালীর অর্থনীতির শক্তি ছিল। তাঁত, মৃৎশিল্প, কাঠখোদাই, ধাতুশিল্প ও নৌকা নির্মাণে দক্ষ স্থানীয় জনপদ ছিল। নোয়াখালীতে মসজিদ,খানকাহ, দরগাহ এবং হিন্দু বৈষ্ণবধারার প্রতিষ্ঠান মিলিতভাবে বহু-ধর্মীয় সংস্কৃতি তৈরি করেছিল। সুফি আউলিয়া ও দরবেশদের আগমনে মানবতাবাদী মূল্যবোধ ছড়িয়ে পড়ে। একই সঙ্গে স্থানীয় নোয়াখাইল্লা ভাষার বিকাশ হয়, যা আজও অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
রাজনৈতিকভাবে নোয়াখালী ছিল কৌশলগত ফ্রন্টলাইন। আরাকান ও পর্তুগিজ জলদস্যুর হুমকি মোকাবিলায় মুঘল সামরিক বাহিনী এখানে ঘাঁটি গড়েছিল।স্বন্দ্বীপ দখল ছাড়া চট্টগ্রামকে ধরে রাখা সম্ভব ছিল না। কৃষকরা ব্রিটিশ আমলে নীলকর ও জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহও করেছিল। ইতিহাস প্রমাণ করে,নোয়াখালী সর্বদাই প্রতিরোধ ও স্বাধিকার আন্দোলনের মাটিতে পরিণত হয়েছে।
আজ নোয়াখালী নদীভাঙন, চর-উচ্ছেদ,দারিদ্র্য ও অবকাঠামোগত পশ্চাদপদতার কারণে তার গৌরব হারিয়েছে। কিন্তু অতীতের শিক্ষা দেখায়-নোয়াখালী আবারও হতে পারে কৃষি, শিল্প ও সংস্কৃতির কেন্দ্র, যদি আমরা নদী, চর, নৌপথ ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে সক্রিয় হই। এটি শুধু ইতিহাস নয়; এটি জাতীয় পুনর্জাগরণের দিশা।
(কবিতা: সুবর্ণ বাংলার নোয়াখালী)
মেঘনার বুকে স্বপ্ন ভেসে যায়,
চরের মাটিতে কৃষকের হাত ঘেষে যায়।
ধানের শীষে সোনার রোদ,
তাঁতের সুতো গ্রামীণ সুরে গায়।
নৌকা ভেসে,পাল তোলে নদীর ঢেউ,
ইতিহাস বয়ে যায় কালের স্রোতে।
সুফির বাণী, আউলিয়ার দোয়া,
হিন্দু বৈষ্ণব উৎসবের রঙিন মেলা।
নোয়াখালীর জনপদ-সংস্কৃতির ধারক,
শিল্পের আধার,সাহসী মানুষের ঘর।
ভাঙন-দুর্যোগে থেমে না যায় প্রাণ,
আবার জাগে,দেয় নতুন আহ্বান।
স্বর্ণযুগের স্মৃতি বয়ে আসে ফিরে,
সোনার বাংলার প্রতিধ্বনি মেলে নদীর পাড়ে।
নোয়াখালী-মাটি, মানুষ, ঐতিহ্যের গান,
আবার জাগুক,বাংলাদেশ হোক সবার মান।
লেখক:মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক ও প্রকাশক
সাপ্তাহিক নবজাগরণ।