মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
১৭ শতকের উপমহাদেশের মানচিত্র আজও আমাদের সামনে এক বিশাল আয়না হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে আমরা দেখি-কোথাও নেই ভারত, নেই পাকিস্তান, নেই বাংলাদেশ। বরং ছড়িয়ে আছে শত শত ছোট-বড় রাজ্য, নবাবি, সুলতানি, সাম্রাজ্য। দিল্লির মোগলরা নামমাত্র শাসন চালালেও বাস্তবে প্রতিটি অঞ্চলে আলাদা শক্তি নিজের আধিপত্য কায়েম করেছিল। এ বিভক্তি শুধু রাজনৈতিক ছিল না, ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিভক্তিও। আর এই ভাঙনের ভেতর দিয়েই প্রবেশ করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি-প্রথমে ব্যবসায়ী, পরে সেনাপতি, শেষে এক সর্বগ্রাসী ঔপনিবেশিক শক্তি।
আজ যখন বাংলাদেশ আবার এক অস্থির রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, তখন সেই ১৭ শতকের মানচিত্র আমাদের নতুন করে সতর্ক করছে। যদি আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা না নেই, তবে আবারও আমরা পরবর্তী প্রজন্মকে বন্দি করে ফেলব দাসত্বের শৃঙ্খলে।
১. ১৭ শতকের মানচিত্র: বিভক্তির ভূগোল
১৭ শতকের উপমহাদেশে একদিকে ছিল মোগল সম্রাট শাহজাহান ও ঔরঙ্গজেবের বিশাল সাম্রাজ্য, অন্যদিকে ছিল মারাঠা শক্তি, দক্ষিণে গোলকোন্ডা ও বিজাপুর সুলতানি, বাংলায় নবাবি, হায়দ্রাবাদের নিজাম,রাজস্থানের রাজপুত, আসামের আহোম, পাঞ্জাবের সিখ সম্প্রদায়-সবাই ছিল ক্ষমতার দ্বন্দ্বে জড়ানো।
মোগলরা দিল্লি থেকে শাসন করলেও তাদের নিয়ন্ত্রণ ছিল ঢিলেঢালা। বাংলার নবাবরা প্রায় স্বাধীনভাবে শাসন চালাতেন। দক্ষিণে বিজাপুর ও গোলকোন্ডা সুলতানিরা মোগল শাসনের প্রতি আনুগত্য দেখালেও নিজেদের ক্ষমতা ছাড়েনি। মারাঠারা আবার দাক্ষিণাত্যের গেরিলা যুদ্ধ করে মোগলদের নাকানি-চুবানি খাওয়াত। পাঞ্জাবে সিখরা ক্রমে সংগঠিত হচ্ছিল এক শক্তিশালী সামরিক সম্প্রদায়ে।
এই মানচিত্র আমাদের শেখায়-ঐক্যের অভাবে শক্তিশালী সাম্রাজ্যও ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়ে যায়।
২. ব্রিটিশ প্রবেশ: ব্যবসা থেকে আধিপত্য
১৬০০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠনের পর ইংরেজরা আসল ব্যবসায়ী সেজে। সুতানুটি, কাসিমবাজার,হুগলির মতো বন্দরনগরে তারা গড়ে তোলে কারখানা (ফ্যাক্টরি)। ভারতীয় রেশম, মসলিন, নীল, মসলা, লবণ
আফিম-সবকিছু তারা সস্তায় কিনে ইংল্যান্ডে নিয়ে যেত।
কিন্তু ধীরে ধীরে তারা বুঝল-যদি এ অঞ্চলে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করা যায় তবে বাণিজ্যিক মুনাফা বহুগুণ বাড়বে। তাই তারা স্থানীয় নবাব-রাজাদের মধ্যে বিভেদ উসকে দিল, কাউকে ঘুষ দিল, কাউকে অস্ত্র দিল, কাউকে প্রতিশ্রুতি দিল। একে একে তারা নিজেদের সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়ে তোলে।
সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে ১৭৫৭ সালে-পলাশীর যুদ্ধ। সেখানে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেনাপতি মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলার পতন ঘটে। এভাবেই ব্যবসায়ী ইংরেজরা উপমহাদেশের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে।
৩. ইতিহাসের সতর্কবার্তা
ইতিহাস স্পষ্টভাবে আমাদের তিনটি বার্তা দেয়-
(ক) বিশ্বাসঘাতকতার মাশুল
সিরাজউদ্দৌলা হয়তো যুদ্ধ জিততে পারতেন, যদি মীর জাফর, জগৎশেঠ, উমিচাঁদ প্রমুখ ধনাঢ্য ও অভিজাতরা ঐক্যবদ্ধ থাকতেন। কিন্তু ব্যক্তিগত লোভ ও ক্ষমতার লালসা দেশকে ধ্বংস করল। আজও কি আমরা নতুন নতুন মীর জাফর তৈরি করছি না?
(খ) দলাদলি মানেই দাসত্ব
মোগল ও মারাঠারা নিজেদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে ইংরেজরা সহজে সুযোগ পেল। রাজপুত, নিজাম, জোতদার, জমিদার-সবার মধ্যে দ্বন্দ্ব চলতে থাকল। জাতি যত বিভক্ত, শত্রুর জয় তত সহজ।
(গ) জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন শাসনের পতন-
নবাব-রাজারা প্রজাদের থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। কৃষকরা হয়ে গিয়েছিল শুধু কর আদায়ের যন্ত্র। জনগণের সঙ্গে শাসকের সংযোগ ছিন্ন হয়ে গেলে রাষ্ট্র দুর্বল হয়-এটাই ইতিহাসের কঠিন শিক্ষা।
৪. বর্তমান বাংলাদেশ: বিভক্তির নতুন মানচিত্র
আজ আমরা ২০২৫ সালের বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে। চারদিকে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, দলাদলি, গোষ্ঠীবাজি। দলগুলো নিজেদের স্বার্থে এতটাই নিমগ্ন যে জাতির বৃহত্তর স্বার্থ ভুলে গেছে।
একদল বিদেশি শক্তির দিকে তাকিয়ে থাকে সমর্থনের আশায়,আরেক দল ভেতরে ভেতরে লুটপাটের ভাগাভাগি নিয়ে ব্যস্ত। জনগণ? তারা আজও শোষণের শিকার। শিক্ষা,স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান-সবখানে বৈষম্য ও বঞ্চনা।
এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। তারা বলবে-আমাদের পূর্বপুরুষরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে ব্যর্থ হয়েছিল।
৫. শত্রু ও মিত্র চিহ্নিত করার জরুরি প্রয়োজন-
আজকের বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় কাজ হলো-শত্রু আর মিত্রকে চিহ্নিত করা।যে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জনগণের শত্রু হয়ে ওঠে, তাকে সংস্কার করতে হবে।যে রাজনৈতিক শক্তি জাতিকে বিভক্ত করে, তাকে প্রতিহত করতে হবে।
যে বিদেশি শক্তি কেবল নিজেদের স্বার্থে আমাদের ব্যবহার করতে চায়, তাদের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন ভারসাম্য গড়তে হবে।একইসঙ্গে আমাদের মিত্র খুঁজতে হবে জনগণের ভেতরে-কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, প্রবাসী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। কারণ জনগণ ছাড়া কোনো রাষ্ট্র টিকে থাকতে পারে না।
৬. নতুন বিপ্লবের ডাক-
১৭ শতকের মানচিত্র আমাদের সতর্ক করছে-ঐক্য ছাড়া মুক্তি নেই। তাই আজ দরকার এক নতুন বিপ্লব।
এ বিপ্লব হবে-বিভক্তি ভেঙে ঐক্যের বিপ্লব,
ক্ষমতালোভী রাজনীতিকে সরিয়ে জনগণের বিপ্লব,
দাসত্বের ইতিহাস ভেঙে স্বাধীনতার পুনর্জন্ম।
৭. দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় কৌশল
আমাদের এখন থেকেই জাতীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে-
১️. শিক্ষা, প্রযুক্তি, শিল্পায়ন ও গবেষণায় দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ।
২️. দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সমান মর্যাদায় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।
৩️. প্রতিরক্ষা ও কূটনীতিতে স্বনির্ভরতা।
৪. দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও জনগণভিত্তিক শাসনব্যবস্থা।
৫️.প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে দেশপ্রেমের শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়া।
৮. বিপ্লবী শ্লোগান
“এক দেশ, এক জনগণ, এক বিপ্লব।”
“ঐক্য ছাড়া মুক্তি নেই।”
“জনগণ ছাড়া রাষ্ট্র নেই।”
“বিপ্লব ছাড়া ভবিষ্যৎ নেই।”
১৭ শতকের মানচিত্র আমাদের সামনে কড়া বার্তা দেয়—বিভক্ত জাতি টিকে থাকতে পারে না। আজ যদি আমরা ঐক্য গড়তে না পারি, যদি আমরা জনগণকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্র চালাই, তবে আগামী প্রজন্ম আমাদের অভিশাপ দেবে।
কিন্তু যদি আমরা শিক্ষা নিতে পারি, তবে এই মানচিত্র শুধু অতীতের ট্র্যাজেডি নয়, বরং ভবিষ্যতের আলোকবর্তিকা হয়ে উঠবে। তখন নতুন বাংলাদেশ, নতুন উপমহাদেশ, এমনকি নতুন বিশ্বের স্বপ্ন আর কল্পনা থাকবে না-তা হবে বাস্তবতা।
লেখক:সম্পাদক, নবজাগরণ
অনলাইনে পড়তে:www.thenabajagaran.com