বিশেষ প্রতিবেদন:
বাংলাদেশের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ কেবল একটি প্রশাসনিক প্রক্রিয়া নয়,বরং এটি একটি সমাজ-ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত প্রতীকী ঘটনা। শিক্ষক মানেই আলোকবর্তিকা-যিনি তাঁর জ্ঞান,মূল্যবোধ ও প্রজ্ঞা দিয়ে প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে যান।সম্প্রতি সেনবাগের ঐতিহ্যবাহী তাহিরপুর আলিম মাদ্রাসায় সহকারী শিক্ষক (বাংলা) হিসেবে জনাবা সুলতানা রাজিয়ার নিয়োগ এমনই এক ঘটনা, যা শুধু মাদ্রাসার নয়, বরং সমগ্র সেনবাগের শিক্ষা ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
সেনবাগের শিক্ষার ইতিহাস:মক্তব থেকে আধুনিক শিক্ষালয়
সেনবাগ অঞ্চল নোয়াখালীর একটি সমৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী জনপদ। এখানে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছে বহু আগে থেকেই। একসময় শিক্ষা বলতে বোঝাত মক্তব ও হাফিজিয়া মাদ্রাসা,যেখানে শিশুদের কোরআন শিক্ষা ও প্রাথমিক আরবি পাঠদান হতো। পরে জমিদার ও দানশীল সমাজপতিদের উদ্যোগে গড়ে ওঠে মাদ্রাসা,প্রাথমিক বিদ্যালয় ও পরে উচ্চ বিদ্যালয়।
১৯৪৭ সালের দেশভাগ ও ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর সেনবাগের শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ হয়। এখানে বহু উচ্চবিদ্যালয়,কলেজ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়, যা স্থানীয় জনগণের শিক্ষার হার বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সেনবাগে তাহিরপুর আলিম মাদ্রাসা কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয়;এটি অঞ্চলের ইসলামি ও আধুনিক শিক্ষার মিলনস্থল। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে মাদ্রাসাটি ধার্মিক,সুশিক্ষিত ও সমাজসেবক মানুষ তৈরি করেছে।স্বনামধন্য আলোচিত প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ আলহাজ্ব মাওলানা মজিবুর রহমান একরামী সাহেবের অক্লান্ত পরিশ্রম ও নেতৃত্বে আজ এই প্রতিষ্ঠানটি শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই নয়, আধুনিক বিষয় শিক্ষাতেও গুরুত্ব দিয়ে আসছে।
নারী শিক্ষার অগ্রযাত্রা: ইতিহাস ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
একসময় সেনবাগ অঞ্চলে মেয়েদের শিক্ষার প্রতি তেমন গুরুত্ব দেওয়া হতো না। সামাজিক কুসংস্কার, দারিদ্র্য ও অভিভাবকদের অনাগ্রহের কারণে অনেক মেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে থেকে যেত। কিন্তু ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলেছে।
১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে স্থানীয় বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় মেয়েদের ভর্তির সংখ্যা বাড়তে থাকে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে মেয়েদের জন্য স্টাইপেন্ড চালু হয়, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টি হয়। এর ফলে বর্তমানে সেনবাগে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অংশগ্রহণ অনেক বেশি।
এই প্রেক্ষাপটে একজন নারী শিক্ষক যখন মাদ্রাসায় যোগ দেন, তা শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে মেয়েদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে। সুলতানা রাজিয়ার নিয়োগ তাই কেবল প্রাতিষ্ঠানিক নয়, বরং সামাজিক রূপান্তরেরও প্রতীক।
বাংলা ভাষা শিক্ষার ভূমিকা
বাংলা কেবল একটি ভাষা নয়; এটি বাঙালি জাতির আত্মপরিচয়, সংগ্রাম ও সংস্কৃতির বাহক। সেনবাগে বাংলা শিক্ষার ইতিহাসও বেশ সমৃদ্ধ। এখানকার মানুষ বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে।
কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে দেখা গেছে, মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় বিষয়ের পাশাপাশি বাংলা ভাষায় দুর্বল হয়ে পড়ছে। এর ফলে উচ্চশিক্ষায় তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাচ্ছে। সুলতানা রাজিয়ার নিয়োগ তাই একটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে। তিনি বাংলা সাহিত্যের সৌন্দর্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, রবীন্দ্র-নজরুলের সৃষ্টিশীলতা এবং আধুনিক সাহিত্য জগৎকে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দিতে পারবেন।
NTRCA প্রক্রিয়া ও স্বচ্ছ নিয়োগের তাৎপর্য
বাংলাদেশের শিক্ষা নিয়োগ ব্যবস্থা বহু বছর ধরে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে বিতর্কিত ছিল। যোগ্য শিক্ষক অনেক সময় নিয়োগ থেকে বঞ্চিত হতেন। কিন্তু NTRCA প্রক্রিয়া সেই ধারা বদলে দিয়েছে।
NTRCA পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সুপারিশ পাওয়া মানে হলো-শিক্ষকটি তাঁর মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। সুলতানা রাজিয়ার নিয়োগ তাই সেনবাগবাসীর জন্য গর্বের, কারণ তাঁরা জানেন এই শিক্ষক একটি নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসছেন।
তাহিরপুর আলিম মাদ্রাসার গুরুত্ব
তাহিরপুর আলিম মাদ্রাসা সেনবাগের শিক্ষাজগতে একটি সম্মানিত নাম। এর শত শত শিক্ষার্থী স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবদান রেখেছেন। ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই মাদ্রাসা প্রমাণ করেছে-শুধু ধর্ম নয়, বরং বিজ্ঞান, সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞানসহ নানা বিষয়ে দক্ষ প্রজন্ম তৈরি করাই এর লক্ষ্য।
সুলতানা রাজিয়ার মতো নতুন শিক্ষক যুক্ত হওয়ায় এই মাদ্রাসায় শিক্ষার মান আরও উন্নত হবে। বিশেষ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক, ভাষা শিক্ষার পরিবেশ এবং মেয়েদের আত্মবিশ্বাস নতুন মাত্রা পাবে।
অভিভাবক ও সমাজের প্রত্যাশা
একজন শিক্ষকের নিয়োগ সমাজের সবার কাছে প্রত্যাশার জন্ম দেয়। অভিভাবকরা আশা করেন, তাঁদের সন্তানরা শুধু বই পড়বে না, বরং আদর্শ, নৈতিকতা ও মানবিকতা শিখবে। বিশেষ করে একজন নারী শিক্ষক মাদ্রাসায় যুক্ত হওয়ায় অভিভাবকরা কন্যাসন্তানদের পড়াশোনায় আরও আগ্রহী হবেন।
অভিভাবক সদস্যদের উপস্থিতি প্রমাণ করে-এটি একটি সম্মিলিত সামাজিক আয়োজন ছিল। সমাজ-অভিভাবক-প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে শিক্ষা যখন এগোয়, তখনই তা সফল হয়।
শিক্ষক সমাজ ও রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার
একজন শিক্ষক নিয়োগ মানে শুধু চাকরি দেওয়া নয়;এটি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি অঙ্গীকার।সেনবাগের মতো গ্রামীণ জনপদে প্রতিটি শিক্ষক আলোর মশাল।সুলতানা রাজিয়ার নিয়োগ তাই শুধু একটি প্রক্রিয়া নয়,বরং একটি প্রতিশ্রুতি-যে প্রতিশ্রুতি মেধা,শ্রম ও নৈতিকতার ভিত্তিতে একটি শিক্ষিত বাংলাদেশ গড়ে তুলবে।
তাহিরপুর আলিম মাদ্রাসায় সুলতানা রাজিয়ার নিয়োগ সেনবাগের শিক্ষা ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। সেনবাগের শতবর্ষের শিক্ষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এটি একটি নতুন অধ্যায়।
এখন দায়িত্ব তাঁর-নিজেকে প্রমাণ করা,শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করা,বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আলোয় নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলা। একজন শিক্ষক যদি তাঁর দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেন, তবে একটি মাদ্রাসা থেকে শুরু করে একটি অঞ্চল,এমনকি একটি জাতি পর্যন্ত বদলে যেতে পারে।
মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক ও প্রকাশক, নবজাগরণ।