মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
ঢাকার রাজপথে এবং ঢাকা মেডিকেলের গলিতে গত কয়েকদিনে যা ঘটেছে, তা কেবল ভিপি নুরুল হক নুরের ওপর হামলা নয়। এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের উপর, জনগণের উপর, জুলাই বিপ্লবের উপর, এমনকি এই রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনার উপর এক গুরুতর আঘাত।
জুলাই বিপ্লবের বাস্তবতা ও সেনাবাহিনীর ভূমিকা
২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম, শিক্ষার্থী, শ্রমিক, প্রান্তিক জনগণ এবং সাংবাদিকদের রক্তে লেখা হয়েছিল এক নতুন ইতিহাস-জুলাই বিপ্লব। সেই বিপ্লব স্বৈরাচার ও গোষ্ঠীবাদের শৃঙ্খল ভেঙে দিয়েছিল। কিন্তু আজ আমরা দেখছি, সেই বিজয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করার এক গভীর ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও তাদের নেতারা সেনাবাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছে। জাতীয় পার্টির স্বৈরাচারী দোসররা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ভারতীয় প্রভাবপুষ্ট তাবেদার শক্তিগুলো আজ নেপথ্যে কলকাঠি নেড়ে যাচ্ছে। আর এই পুরো ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছে সেনাবাহিনীর কিছু গোষ্ঠী, যারা নিজেদেরকে প্রজাতন্ত্রের রক্ষক নয় বরং রাজনৈতিক খেলার অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে।
নুরের ওপর হামলা-এক ভয়ঙ্কর সংকেত
ঢাকা মেডিকেলে নুরুল হক নুরকে ঘেরাও করা, তার কর্মীদের উপর হামলা, টয়লেটের দরজা ভেঙে নির্যাতন-এসব কেবল বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এগুলো আসলে আগামীর বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রাকে রুদ্ধ করার পূর্বাভাস। আজ নুরকে মারছে, কাল যে কেউ-আপনি, আমি কিংবা অন্য কোনো আন্দোলনকর্মী-এর শিকার হতে পারি।
প্রশ্ন হলো: সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা কি ভুলে গেছেন যে তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, জনগণের টাকায় বেতন পান? নাকি তারা আবারো ৭৫ কিংবা ৮২ সালের মতো ইতিহাসকে পুনরাবৃত্তি করতে চাইছেন?
রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও জনগণের মালিকানা
বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা জনগণের রক্তে অর্জিত। কোনো সেনানায়ক বা রাজনৈতিক গোষ্ঠীর দয়ার দান নয়। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় কেনা অস্ত্র যদি জনগণের উপরই চালানো হয়, তাহলে রাষ্ট্র আর প্রজাতন্ত্র থাকে না-তখন সেটা হয়ে যায় দখলদার গোষ্ঠীর সামরিক আস্তানা।
জুলাই বিপ্লব স্পষ্ট করে দিয়েছে-এদেশে আর স্বৈরাচার, দমননীতি কিংবা ভারতীয় প্রভাবের তাবেদারি চলবে না। জনগণ একবার জেগেছে, তারা আর কখনো ঘুমাবে না।
রাজনৈতিক দলগুলোর করণীয় আজকে জরুরি হলো সব রাজনৈতিক দল-বড় হোক বা ছোট, বাম, ডান বা মধ্যপন্থী-এক কণ্ঠে বলা: সেনাবাহিনী রাজনীতির মাঠে নামবে না।
বিএনপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, জামায়াত কিংবা বাম গণতান্ত্রিক জোট-যেই হোক, সবার জন্য এই বার্তা একই: নুরের ওপর হামলা মানে আপনার দলের ভবিষ্যতের ওপর হামলা।
আওয়ামী লীগকেও নিজেদের ইতিহাসের দিকে তাকাতে হবে। একদিন যে সেনাশক্তির উপর ভর করে টিকে থাকার স্বপ্ন দেখছেন, কাল সেই সেনাশক্তি আপনাদেরই নিঃশেষ করে দেবে। নতুন প্রজন্মের বিকল্প শক্তিগুলোর জন্য এটাই সময়-স্পষ্টভাবে অবস্থান নেওয়া: বাংলাদেশে সামরিক রাজনীতি চলবে না, জনগণই একমাত্র সার্বভৌম।
সরকারের ভূমিকা ও দায়িত্ব:বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে এখানে একেবারেই দ্ব্যর্থহীন অবস্থান নিতে হবে। সেনাবাহিনী যদি জনগণের রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করে, তবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংবিধানিক পদক্ষেপ নিতে হবে। এই রাষ্ট্র গণতন্ত্রের-এটি কোনো সামরিক ছাউনি নয়। যদি সরকার নীরব থাকে, তবে জনগণই আবার রাস্তায় নামবে। তখন সেনাশক্তি নয়, জনগণের শক্তিই চূড়ান্ত ফয়সালা করবে।
সময়ের ফয়সালা-ইতিহাসের গতিপথে এমন মুহূর্ত আসে, যখন সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকে না। জুলাই বিপ্লব সেই সিদ্ধান্তের প্রথম অধ্যায় লিখেছে। এখন দ্বিতীয় অধ্যায় লেখা হবে-সেনাশক্তির ছায়ার বিরুদ্ধে সর্বজনীন রাজনৈতিক ঐক্যের মাধ্যমে।
আজকের প্রশ্ন হলো: আমরা কি আবার ৭৫-এর বিভীষিকায় ফিরে যাব, নাকি জুলাই বিপ্লবের অঙ্গীকার অনুযায়ী একটি নতুন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ব?
নুরের ওপর হামলা কেবল একজন নেতার ওপর আঘাত নয়। এটি আসলে আমাদের প্রত্যেকের উপর আঘাত। প্রতিটি রাজনীতিক, প্রতিটি সাংবাদিক, প্রতিটি ছাত্র, প্রতিটি নাগরিকের জন্য একটি সতর্কবার্তা।
এই আক্রমণ স্পষ্ট করে দিয়েছে-যদি এখনই রাজনৈতিক দলগুলো এক কণ্ঠে না বলে,সেনাশক্তির রাজনীতিতে কোনো স্থান নেই’, তবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ে সীমাবদ্ধ থাকতে হবে।
কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি-বাংলার মাটি থেকে আবারও জনগণের কণ্ঠ গর্জে উঠবে। গণতন্ত্রকে কোনো ট্যাঙ্ক, কোনো রাইফেল, কোনো ষড়যন্ত্র চিরকাল দমিয়ে রাখতে পারবে না।
নতুন বাংলাদেশ-গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ-গড়ে উঠবেই।
লেখক:মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক-
নবজাগরণ
অনলাইনে পড়তে: www.thenabajagaran.com