দুই সরকারের বাংলাদেশ:জুলাই বিপ্লবের অর্জন নাকি ষড়যন্ত্রের ফাঁদ?

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
এক অদ্ভুত বাস্তবতা বাংলাদেশ আজ এমন এক বাস্তবতার মুখোমুখি যেখানে মনে হচ্ছে দেশে দুটি সরকার চলছে। একটি হলো আনুষ্ঠানিক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার,যার নেতৃত্বে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।অন্যটি হলো অদৃশ্য ছায়া-সরকার,যা নিয়ন্ত্রণ করছে সেনাবাহিনী,পুলিশ,আওয়ামী লীগের অবশিষ্ট দোসর এবং ভারতের দালালরা।

এই দ্বৈত শাসনব্যবস্থা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। মানুষ বুঝতে পারছে না-কে আসল শাসক? কার হাতে সিদ্ধান্ত? বিপ্লবী স্বপ্নের ফসল আজ ষড়যন্ত্রের জালে জড়িয়ে পড়ছে। এ যেন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি-১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর যেমন জনগণের হাতে ক্ষমতা যায়নি,১৯৯০ সালের গণআন্দোলনের পর যেমন জনতার শক্তিকে দলীয় স্বার্থে খণ্ড-বিখণ্ড করা হয়েছিল,আজও তেমনই এক বিপজ্জনক মোড়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি।

জুলাই বিপ্লব:আশা ও অর্জন
২০২৪ সালের জুলাই মাসে যে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল,তা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অভূতপূর্ব ঘটনা। লাখো তরুণ,শ্রমজীবী মানুষ,ছাত্র-শিক্ষক,পেশাজীবী সবাই মিলে এক ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিল।

হাজারো মানুষ শহীদ হয়েছেন। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বর্বরতা সত্ত্বেও মানুষ ভয় পায়নি। আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের দুঃশাসন ভেসে গিয়েছিল জনতার স্রোতে।
এই বিজয় ছিল শুধু একটি সরকারের পতন নয়,বরং একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন ছিল-নতুন সংবিধান জনগণের ক্ষমতায়ন ন্যায়ভিত্তিক অর্থনীতি প্রশাসনিক সংস্কার
বিদেশি প্রভুমুক্ত স্বাধীন নীতি
কিন্তু সেই স্বপ্ন পূর্ণ রূপ নিতে পারেনি। কারণ বিপ্লবের মুহূর্তে যে কাজটি সবচেয়ে বেশি জরুরি ছিল-একটি বিপ্লবী সরকার গঠন-তা করা হয়নি।

অন্তর্বর্তী সরকারের সীমাবদ্ধতা
আওয়ামী ফ্যাসিবাদ পতনের পর একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হলো। নেতৃত্বে এলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ব্যক্তিগতভাবে তিনি বিশ্বমঞ্চে সম্মানিত,কিন্তু রাজনীতির জটিল বাস্তবতায় অভিজ্ঞ নন। এই সরকারের সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট:
আদর্শগত অস্পষ্টতা:তারা বিপ্লবী নাকি সংস্কারকামী,তা স্পষ্ট নয়।

প্রশাসনিক জড়তা: পুরনো আমলাতন্ত্র আগের মতোই প্রভাবশালী রয়ে গেছে। জনগণের অংশগ্রহণহীনতা:সাধারণ মানুষ সরকারের সাথে সরাসরি যুক্ত হতে পারছে না।
কূটনৈতিক চাপ:ভারতসহ আঞ্চলিক শক্তির প্রভাব স্পষ্ট।
ফলাফল-এই সরকার জনগণের চোখে বৈধ হলেও কার্যকর নয়।

ছায়া-সরকারের উত্থান অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে ছায়া-সরকার। এর চালিকাশক্তি হলো:
সেনাবাহিনী ও পুলিশ:বিপ্লবের সময় জনগণের সাথে থেকে তারা আওয়ামী ফ্যাসিবাদ পতনে ভূমিকা রাখলেও আজ তারা পুরনো প্রভুত্ববাদী মানসিকতা থেকে বেরোতে পারেনি। নিরাপত্তার নামে তারা আবারও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করছে।

আওয়ামী লীগের দোসর:আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালেও তাদের দোসররা আজও প্রশাসন,মিডিয়া,অর্থনীতি,গ্রামীণ রাজনীতিতে শক্তভাবে বসে আছে। এরা সুযোগ পেলেই নাশকতা করে,অস্থায়ী সরকারকে অকার্যকর প্রমাণ করতে চায়।

ভারতের দালাল:বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব ভারতকে বারবার এখানে হস্তক্ষেপে উৎসাহিত করে। তাদের কৌশল সহজ-বাংলাদেশ যেন কখনোই একটি শক্তিশালী স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত না হয়। তাই তারা ছায়া-সরকারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখছে।
এই তিন শক্তি মিলে কার্যত একটি ছায়া-সরকার পরিচালনা করছে,যা অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রমকে দুর্বল করছে।

রাজনৈতিক দলের বিভাজন:বিএনপি ভেবেছিল, আওয়ামী পতন মানেই তাদের জন্য স্বয়ংক্রিয় ক্ষমতার দরজা খুলে যাবে। কিন্তু জনগণের বিদ্রোহ আওয়ামী লীগকে উৎখাত করার জন্য ছিল,বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য নয়। তাদের ইতিহাস দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিতে কলঙ্কিত। ফলে তারা দিন দিন জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে।

জামায়াত ও এনসিপি নিজেদের ভুল পথে হাঁটছে। তাদের সঙ্গে জনতার দূরত্ব বাড়ছে। অন্যদিকে কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী বিদেশি প্রভুর ইশারায় প্রতিদিন বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে, অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ প্রমাণ করতে চাইছে।

জনগণের হতাশা:জনগণ যে ঐক্যের শক্তি দিয়ে জুলাই বিপ্লব করেছিল,সেই ঐক্য আজ ভেঙে যাচ্ছে। মানুষ বুঝতে পারছে না-আসল ক্ষমতা কার হাতে। গ্রামে-শহরে বিভ্রান্তি বাড়ছে। তরুণ বিপ্লবীরা হতাশ হচ্ছে। এভাবেই বিপ্লবী শক্তি ক্ষয় হয়ে যায়।

ইতিহাসের শিক্ষা:বাংলাদেশের ইতিহাস স্পষ্ট শিক্ষা দেয়:
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর একটি বিপ্লবী গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ফলে সুযোগ নিয়েছিল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। ১৯৯০ সালে এরশাদ পতনের পর আবারও জনগণের শক্তি দলে দলে ভেঙে পড়েছিল।
আজ যদি আমরা দুই সরকারের এই দ্বৈত শাসনের ফাঁদে পড়ে থাকি,তাহলে জুলাই বিপ্লবের বিজয়ও হাতছাড়া হবে।

করণীয়:এখনো সময় আছে। যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ হই, তাহলে এই ষড়যন্ত্র ভাঙা সম্ভব।
সেনাবাহিনী,পুলিশ ও আমলাতন্ত্রের ভেতরে থাকা আওয়ামী দোসর ও ভারতের দালালদের চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারকে রূপান্তরিত করতে হবে জনগণের বিপ্লবী সরকারে,যেখানে থাকবে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ।

জুলাই বিপ্লবের শহীদদের রক্তের শপথে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। সব রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে একটি ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবী ফ্রন্ট গঠন করতে হবে। বিদেশি হস্তক্ষেপ রুখতে হবে দৃঢ় কূটনৈতিক অবস্থান নিয়ে।

সাবধান!
বাংলাদেশে দুই সরকার চলতে পারে না।
একটাই সরকার থাকবে-জনগণের বিপ্লবী সরকার।
যারা সেনাবাহিনী,পুলিশ বা প্রশাসনের ভেতরে থেকে আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে রক্ষা করছে,যারা ভারতের দালাল হয়ে দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন করছে-তাদেরকে চিহ্নিত করে অতিদ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা অনিবার্য।

আজ আর দ্বিধা করার সময় নেই।
সাবধান! হাতে শিকল আসছে।
ঐক্যবদ্ধ হও,দালালদের নির্মূল করো,
নয়তো জুলাই বিপ্লবের ঐতিহাসিক বিজয় হাতছাড়া হবে।