মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
সম্পাদক, নবজাগরণ
বাংলাদেশ আজ আবারও ইতিহাসের মোড়ে দাঁড়িয়ে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও এই দেশকে কেন বারবার রক্তে স্নাত হতে হয়, কেন গণতন্ত্রকে দমন করতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও ক্ষমতালোভী রাজনীতির দোসররা একাকার হয়ে ওঠে-এ প্রশ্ন আজ জনতার হৃদয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। সদ্য সংঘটিত ঘটনা-ডাকসুর সাবেক ভিপি ও গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরসহ নেতাকর্মীদের উপর হামলা-শুধু একটি রাজনৈতিক আক্রমণ নয়; এটি পুরো জাতির উপর ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রকাশ্য ঘোষণা। আর সেই হামলার প্রতিবাদেই রাজধানীতে আয়োজিত হয়েছে ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির সংহতি সমাবেশ, যা ইতিমধ্যেই নতুন রাজনৈতিক জাগরণের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
হামলার দিন: রক্তাক্ত ষড়যন্ত্রের চিত্র
ঘটনার দিন রাজধানীর কাকরাইলে একটি রাজনৈতিক সমাবেশ থেকে ফেরার পথে নুরুল হক নুর ও তার সহকর্মীদের উপর অতর্কিত হামলা চালানো হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, সেনা ও পুলিশের উপস্থিতিতেই হামলাকারীরা লাঠি-সাঁড়াশির মতো আক্রমণ চালায়। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে-একজন লাল গেঞ্জি পরিহিত হামলাকারী গজারি কাঠ দিয়ে নুরের মাথায় উপর্যুপরি আঘাত করছে। হামলার সময় রাষ্ট্রীয় বাহিনী হস্তক্ষেপ না করে বরং আড়াল দেয় হামলাকারীদের।
এই দৃশ্য বাংলাদেশকে ৭০-এর দশকের পাকবাহিনী দমন-পীড়নের দিনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে-এ বাহিনী আসলে কার? জনগণের, নাকি ক্ষমতাধর গোষ্ঠীর প্রহরী?
হামলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট-
নুরুল হক নুর কেবল একজন রাজনৈতিক নেতা নন; তিনি জুলাই বিপ্লব ২০২৪-এর অন্যতম মুখপাত্র। তার নেতৃত্বেই কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে জুলাইয়ের রক্তঝরা দিনে ছাত্র-জনতার ঢেউ তৈরি হয়। সেই বিপ্লবই ক্ষমতার মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছে। ফলে নুর ও তার সংগঠন আজ ক্ষমতালোভী গোষ্ঠীর চোখে প্রধান শত্রু।
জাতীয় পার্টি, আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের দোসররা আজ নতুন কৌশলে আবারও ফ্যাসিবাদী রাজনীতির জাল বিস্তার করছে। হামলা সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশ।
সংহতি সমাবেশ: বিপ্লবী ঐক্যের মঞ্চ
ঘটনার পর গণঅধিকার পরিষদের ডাকে রাজধানীতে আয়োজিত হয় ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির সংহতি সমাবেশ। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন বাম, প্রগতিশীল, ইসলামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি। সমাবেশে ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠে তিনটি প্রধান দাবি উচ্চারিত হয়-
১. হামলাকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও বিচার।
২. হামলার দায় স্বীকার করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ।
৩. জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের মতো দোসর রাজনীতির নিষিদ্ধকরণ।
সমাবেশে বক্তারা আরও ঘোষণা দেন-এটি কেবল নুরের উপর হামলার বিচার নয়; এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, জনগণের রক্ত ও স্বাধীন ভবিষ্যতের জন্য এক নতুন বিপ্লবী ডাক।
প্রশাসনের ভূমিকা: নিরপেক্ষ নয়, সরাসরি সহযোগী
প্রশ্ন হলো-যে সেনা ও পুলিশ বাহিনী জনগণের টাকায় পরিচালিত, তারা কেন জনগণকে রক্ষায় ব্যর্থ হলো? বরং তারা হামলাকারীদের প্রশ্রয় দিল কেন? নীরব দর্শক হয়ে থাকার এই ভূমিকা আসলে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নয়; বরং সরাসরি সহযোগিতা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা দেখেছি-কখনো কুড়িগ্রামে সাংবাদিককে নির্যাতন করা ডিসি, কখনো আন্দোলনরত ছাত্রদের উপর পুলিশি গুলি, কখনো আবার রাজনৈতিক কর্মীদের তুলে নেওয়া-সবই এক সূত্রে গাঁথা। রাষ্ট্রযন্ত্রের মূল কাঠামো আজ ফ্যাসিবাদী স্বার্থ রক্ষার ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জাতীয় পার্টি ও ১৪ দল: ইতিহাসের কলঙ্ক-
জাতীয় পার্টির জন্ম হয়েছে এক সামরিক স্বৈরাচারের হাত ধরে। এ দলটি আজও ক্ষমতার জন্য যেকোনো শক্তির দালালি করতে প্রস্তুত। অন্যদিকে ১৪ দল, যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে ক্ষমতায় টিকে থেকেছে, তারাই এখন ফ্যাসিবাদী কৌশলের অংশীদার। ফলে জনগণের কাছে এদের রাজনীতি আজ এক কলঙ্ক ছাড়া কিছু নয়।
সংহতি সমাবেশ থেকে তাই সঠিকভাবেই দাবি উঠেছে-এই ধরনের দোসর রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।
বিপ্লবী ঐক্যের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রতিটি আন্দোলনই ঐক্যের মাধ্যমে বিজয়ী হয়েছে। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ কিংবা সাম্প্রতিক জুলাই বিপ্লব-সব ক্ষেত্রেই ছাত্র-জনতার ঐক্যই ছিল মূল চালিকা শক্তি।
আজ নুরের উপর হামলার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা সংহতি সমাবেশও সেই ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতারই অংশ। এই ঐক্য যদি বিস্তৃত হয়, তবে ফ্যাসিবাদী শক্তিকে আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ-
জুলাই বিপ্লব ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে-রাষ্ট্রযন্ত্র যতই শক্তিশালী হোক, জনগণের ইচ্ছাশক্তির কাছে তারা পরাজিত। নুরের উপর হামলা সেই বিপ্লবকে স্তব্ধ করতে চাওয়া এক মরিয়া প্রচেষ্টা। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়-যেখানে রক্ত ঝরে, সেখানেই জন্ম নেয় নতুন প্রতিরোধ।
আজকের সংহতি সমাবেশ শুধু নুরের উপর হামলার জবাব নয়, বরং এক নতুন রাষ্ট্র, নতুন সংবিধান, নতুন বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার।
বাংলাদেশ আজ এক সন্ধিক্ষণে। একদিকে সেনা-পুলিশ ও রাজনৈতিক দোসরদের ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, অন্যদিকে জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। নুরের উপর হামলার বিচার তাই কেবল একটি মামলার বিষয় নয়; এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যতের প্রশ্ন।
ফ্যাসিবাদকে পরাস্ত করতে হলে প্রয়োজন সর্বস্তরের ঐক্য, জনতার শক্তি ও বিপ্লবী সাহস। নুর আজ শুধু একজন নেতা নন, তিনি প্রতিরোধের প্রতীক।
আজকের সমাবেশ তাই ঘোষণা করছে-
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ফ্যাসিবাদের হাতে নয়, জনগণের হাতে। নুরের রক্তের হিসাব চাই, জনগণের রক্তের প্রতিশোধ চাই।রাষ্ট্রের আসল মালিক জনগণ, বাহিনী নয়, দোসর নয়।
বাংলাদেশের আকাশে আবারও গর্জে উঠুক সেই শপথ-
“ফ্যাসিবাদ নিপাত যাক, বিপ্লব মুক্তি পাক।”
অনলাইনে পড়তে www.thenabajagaran.com