জুলাই বিপ্লব-বাংলাদেশ থেকে নেপাল,ভারত হয়ে বিশ্বমুক্তির পথে-এক অগ্নিশিখার নাম জুলাই

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
২০২৪ সালের জুলাই মাস-বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অমর মাস। এই মাসে যে বজ্রনিনাদ উঠেছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট থেকে; যে শ্লোগানে কেঁপে উঠেছিল গ্রাম ও শহরের রাজপথ; যে রক্ত ঝরেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস, কলেজ মাঠ, গ্রামীণ হাট-বাজারে-তা শুধু একটি সরকারের পতনের ইতিহাস নয়। এটি মানবমুক্তির ইতিহাস, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস, বিশ্ব শোষণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ইতিহাস।

বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম সেদিন প্রমাণ করেছে-অস্ত্রহীন জনতার শক্তি যখন একত্র হয়, তখন ট্যাঙ্ক, গুলি, বুলেট, আইন, প্রশাসন কিছুই তাকে রুখতে পারে না। ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব তাই কোনো ভূখণ্ডগত ঘটনা নয়, এটি একটি ধারণা, একটি চেতনা, একটি মহাপাঠ। এই পাঠ আজ ছড়িয়ে পড়ছে নেপালে, জ্বলছে ভারতের আকাশে, আর ধেয়ে যাচ্ছে বিশ্বের দিকে।

বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব-রক্তে লেখা সূচনা
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলো দমন-পীড়ন, দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে। শাসকগোষ্ঠী দেশের অর্থনীতি লুট করেছে, শিক্ষাকে ধ্বংস করেছে, বিচারব্যবস্থাকে দাসে পরিণত করেছে, আর প্রশাসনকে পরিণত করেছিল লুটপাটের যন্ত্রে।

জুলাই বিপ্লবের সূচনা হয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে। ছাত্ররা একে একে রাজপথে নামে-কোটা সংস্কারের দাবিতে, শিক্ষার ন্যায্যতা ফেরাতে, কাজের ন্যায্য অধিকার আদায়ে। রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনী গুলি চালায়, টিয়ার গ্যাস ছোঁড়ে, রক্ত ঝরায়। কিন্তু রক্তে ভিজে ওঠা মাটিই হয়ে ওঠে নতুন ইতিহাসের জন্মদাত্রী।
ঢাকার রাজপথে, গুলিস্তান থেকে শাহবাগ, ফার্মগেট থেকে মিরপুর-চারদিকে তখন একটাই ধ্বনি:
“স্বৈরাচার নিপাত যাক, জনগণের নবজাগরণ হোক।”

এই নবজাগরণ দ্রুত গ্রামে পৌঁছে যায়। কৃষক জমির ন্যায্য দাম দাবি করে, গার্মেন্টস শ্রমিকরা মজুরি বাড়ানোর জন্য কারখানা দখল করে, রিকশাচালকরা হরতাল ডাকে, শিক্ষক-চিকিৎসকরা যোগ দেন এই স্রোতে। জুলাই মাসে গোটা বাংলাদেশ হয়ে ওঠে এক বিশাল রাজপথ, আর সেই রাজপথে উচ্চারিত প্রতিটি স্লোগান পরিণত হয় রাষ্ট্রবদলের নীলনকশায়। অবশেষে শাসকগোষ্ঠীর পতন ঘটে। কিন্তু পতনের চেয়েও বড় বিষয় হলো-বাংলাদেশ নতুন চেতনার জন্ম দেয়। এক নতুন সমাজচুক্তির, এক নতুন ভবিষ্যতের।

নেপালের অগ্নিশিখা
বাংলাদেশের রক্তমাখা বিপ্লবের খবর সীমান্ত পেরিয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। নেপালের তরুণরা তখন দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলো রাজতন্ত্র ও দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের দখলদারিতে। সংসদে দুর্নীতি, মন্ত্রিপরিষদে গোষ্ঠীগত লুট, আর গ্রামীণ জনগণের দারিদ্র্য নেপালের সমাজকে এক অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছিল।

জুলাইয়ের ঢেউ আছড়ে পড়ে কাঠমান্ডুতে। ছাত্ররা পার্লামেন্ট ঘেরাও করে, শ্রমিকরা ধর্মঘট ডাকে, কৃষকরা জমির ন্যায্য মালিকানা দাবি করে। একদিন, ভোরবেলায়, লক্ষাধিক জনতা পার্লামেন্ট ভবন ঘিরে ফেলে-চিৎকার ওঠে:“বাংলাদেশ দেখিয়েছে, এবার নেপালের পালা!”
পুলিশ প্রতিরোধ করে, কিন্তু প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে যায় জনতার বুকে। পার্লামেন্ট ভেঙে পড়ে, মন্ত্রী-এমপিরা পালায়। নেপাল ঘোষণা দেয়-“আমরা জনগণের ক্ষমতা চাই, রাজতন্ত্র নয়।”
বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব নেপালকে দেখিয়েছে যে দমনযন্ত্র যত শক্তিশালীই হোক, ঐক্যবদ্ধ জনতা তার চেয়ে শক্তিশালী।

ভারতের আকাশে জ্বলছে বিপ্লবের মশাল
ভারত এক সুবিশাল রাষ্ট্র। এখানে বৈষম্য, দমন, জাতপাত, ধর্মীয় বিভাজন, সামরিক দমননীতি, কাশ্মীর-মণিপুর-অসমে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বহুদিন ধরে চলছিল।
বাংলাদেশ ও নেপালের খবর ভারতীয় তরুণদের হৃদয়ে আগুন জ্বেলে দেয়। দিল্লির বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয় প্রতিবাদ, কলকাতা ও গৌহাটিতে শ্রমিকরা ধর্মঘট ডাকে। মণিপুর, নাগাল্যান্ড, আসাম, কাশ্মীর-সবখানে স্বাধীনতাকামীদের কণ্ঠস্বর আরও জোরালো হয়।

ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্র এটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করে দমন করতে চেয়েছিল। কিন্তু জুলাইয়ের শিক্ষা ভারতীয় তরুণদের বলেছে-“ভয় পেও না, রক্ত দাও, স্বাধীনতা ছিনিয়ে নাও।” ফলে দিল্লির আকাশে জ্বলে ওঠে আগুনের মশাল, রাস্তায় নামে লাখো মানুষ।এবারের স্লোগান শুধু ভারতের জন্য নয়, বরং গোটা উপমহাদেশের জন্য:
“শোষণমুক্ত এশিয়া চাই, মানুষের স্বাধীনতা চাই।”

বিশ্বমুক্তির ডাক
বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব এখন আর শুধু একটি জাতীয় ঘটনা নয়-এটি বৈশ্বিক আন্দোলনের অনুপ্রেরণা।
লাতিন আমেরিকার চিলি, ব্রাজিল, ভেনিজুয়েলার শ্রমিক সংগঠনগুলো বাংলাদেশের তরুণদের ছবি বহন করছে মিছিলে। আফ্রিকার নাইজেরিয়া, সুদান, কঙ্গোতে কৃষকরা বলছে-“আমরা বাংলাদেশ শিখেছি।” মধ্যপ্রাচ্যের ফিলিস্তিনি তরুণরা স্লোগান তুলছে-“জুলাই বিপ্লব আমাদের পথ দেখায়।” ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ব্যানারে লেখা হচ্ছে-“Bangladesh July Revolution- The New Dawn of Humanity.”

একটি বিষয় পরিষ্কার: শোষক রাষ্ট্রগুলো যত শক্তিশালী হোক না কেন, মানুষের ঐক্যবদ্ধ শক্তি তাকে টিকিয়ে রাখতে পারে না। পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, পরিবারতন্ত্র, রাজতন্ত্র-সব ভেঙে পড়বে একদিন। সেদিন পৃথিবীতে থাকবে না কোনো সীমান্ত, থাকবে না কোনো দমন। থাকবে শুধু ভালোবাসা, থাকবে সমতা, থাকবে মানুষের অধিকার। বাংলাদেশ সেই দিনের পথপ্রদর্শক। নেপাল সেই পথের দ্বিতীয় অধ্যায়। ভারত তৃতীয় অধ্যায়। আর গোটা বিশ্ব এখন চতুর্থ অধ্যায়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।

ইতিহাসের ডাক:জুলাই বিপ্লব আমাদের শিখিয়েছে-রক্ত কখনো বৃথা যায় না। আত্মত্যাগ ইতিহাস তৈরি করে, ইতিহাস মানবতার নতুন ভবিষ্যত গড়ে তোলে। আজকের ডাক তাই কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, কেবল নেপাল বা ভারতের জন্য নয়-এটি মানবতার জন্য। উঠো, দাঁড়াও, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও। জুলাই বিপ্লবের ডাক এখন বিশ্বমুক্তির ডাক। বাংলাদেশ দেখিয়েছে পথ-এবার সমগ্র পৃথিবীকে জাগতে হবে।

সবাই শেয়ার করুন অনলাইনে পড়তে :
www.thenabajagaran.com