জনতার বিজয় বনাম শাসকের প্রতারণা: নতুন রাষ্ট্রচিন্তার সময়”

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল রক্ত, আত্মত্যাগ ও অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের বিনিময়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষ তার জীবন বাজি রেখেছিল স্বাধীনতার জন্য। স্বাধীনতা মানে শুধু দেশ নয়, দেশের মানুষের জন্য ন্যায্যতা, সমতা ও মর্যাদা-এটাই মূল লক্ষ্য ছিল। কিন্তু অর্ধশতাব্দী পার হলেও সেই স্বপ্ন আজো পূর্ণতা পায়নি।

ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয়-
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুধু দেশের স্বাধীনতার লড়াই নয়, বরং শোষণমুক্ত সমাজের জন্য একটি গণসংগ্রামের প্রতীক। মুক্তির পরপরই দেশকে শাসন করতে শুরু করে শাসকগোষ্ঠী যারা স্বাধীনতার আদর্শকে ভুলে, কেবল নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে চায়। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, অভ্যুত্থান, সামরিক শাসন-সবই প্রমাণ যে, রাষ্ট্রের ক্ষমতা আর জনগণের কল্যাণ কখনো একসাথে চলেনি।

উন্নয়ন ও অগ্রগতির নামে কখনো জনগণকে প্রতারিত করা হয়েছে। জনগণ ভোট দিয়েছে, আন্দোলন করেছে, রাস্তায় নেমেছে, কিন্তু ক্ষমতার খেলা কখনো থামেনি। ৯০-এর গণঅভ্যুত্থান, ২০০৭ সালের জরুরি অবস্থা, ২০১৪-২০২৪ সালের নির্বাচন কেন্দ্রিক আন্দোলন-সবই প্রমাণ করে, জনগণ বারবার জীবন দিয়েছে, কিন্তু শাসকগোষ্ঠী প্রতারণার চক্র চালিয়ে গেছে।

নির্বাচন বনাম জনগণের মুক্তি-
বেশিরভাগ মানুষ এখনো বিশ্বাস করে-সুষ্ঠু নির্বাচনই সব সমস্যার সমাধান। কিন্তু বাস্তবতা অন্য। নির্বাচন হয়, সরকার বদলায়, কিন্তু জনগণের জীবন একই জায়গায় আটকে থাকে। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির পাহাড় গড়ে ক্ষমতায় আসা দলগুলো দুর্নীতি, আত্মসাৎ ও ক্ষমতার অপব্যবহারে নিমজ্জিত হয়। আজও লাখ লাখ শিক্ষার্থী ভবিষ্যৎহীন, কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত, শ্রমিক ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির ফাঁদে ফেলে জনগণ বারবার প্রতারণার শিকার হয়।

রাষ্ট্র কাঠামোর ত্রুটি-
বাংলাদেশের সংবিধান, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা-সবই মূলত শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। বিচার ব্যবস্থা রাজনৈতিক প্রভাবে নিয়ন্ত্রিত, প্রশাসন দলীয়করণে পঙ্গু, পুলিশ জনগণের সেবক নয়, শাসকের পাহারাদার।
যে রাষ্ট্র কৃষককে তার উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য দিতে পারে না, শ্রমিককে তার শ্রমের সম্মান দিতে পারে না, শিক্ষার্থীকে গুণগত শিক্ষা দিতে পারে না, সেই রাষ্ট্র কি সত্যিই জনগণের?

শিক্ষা, কৃষি, শ্রম ও ন্যায়বিচারের সংকট-
শিক্ষা: বাংলাদেশে শিক্ষা এখন বাণিজ্যিক বিষয়। এসএসসি-এইচএসসিতে লাখ লাখ শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়, কিন্তু একটি সাবলীল নীতি নেই তাদের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য। শিক্ষার্থীরাই রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছে, কিন্তু শিক্ষার মান বৃদ্ধি হচ্ছে না।
কৃষি: কৃষক সারাবছর খেটে ঘরে ফিরছে শূন্য হাতে। মৌসুম শেষে ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে আত্মহত্যা করছে। সরকারী নীতি কৃষককে সহায়তা না দিয়ে শুধু ধনীদের জন্য প্রণোদনা দেয়।

শ্রমিক: শ্রমিকরা কারখানায় দিনরাত খেটে দেশের অর্থনীতি সচল রাখে। তবু তাদের ন্যায্য মজুরি নেই, জীবনমান মানবেতর। শ্রমিক আন্দোলন দমন করা হচ্ছে।
বিচার: ধনী ও প্রভাবশালী ছাড়া সাধারণ মানুষ ন্যায়বিচার পায় না। মামলা বছরের পর বছর লটকা থাকে, পুলিশ ও প্রশাসন রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে নিরপেক্ষ হয় না।

তরুণ প্রজন্মের নবজাগরণ-
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব প্রমাণ করেছে-তরুণরা আর অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবে না। শিক্ষার্থী, যুবক, সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছে। জীবন বাজি রেখেছে। এই তরুণরাই রাষ্ট্রকে নতুন দিশা দেখাতে পারে। তাদের শক্তি যদি সংগঠিত হয়, তবে পুরোনো প্রতারণার চক্র ভাঙা সম্ভব।

বিশ্ব প্রেক্ষাপট ও বাংলাদেশের অবস্থান-
শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়ে মানুষ দুর্নীতি ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে। শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া-সবখানেই জনগণ রাস্তায় নেমেছে। বাংলাদেশের আন্দোলন বিশ্বব্যাপী ন্যায়ের সংগ্রামের অংশ। আমাদের শিক্ষা নিতে হবে-জনগণের ঐক্যই শাসককে পরাজিত করতে পারে।

ভবিষ্যৎ রূপরেখা-
১. নতুন সংবিধান: শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান মৌলিক অধিকার হিসেবে নিশ্চিত হবে।
২. বিচার ও প্রশাসন স্বাধীন: পুলিশ জনগণের সেবক হবে।
৩. কৃষক-শ্রমিকবান্ধব অর্থনীতি: উৎপাদকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত হবে।
৪. শিক্ষা সংস্কার: কোনো সন্তান আর্থিক কারণে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে না।
৫. তরুণ নেতৃত্বের উত্থান: পুরোনো রাজনৈতিক দলের দাস নয়, জনগণের প্রতিনিধি।

বাংলাদেশ আজ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। সামনে দুটি পথ-একদিকে পুরোনো প্রতারণার চক্রে ফিরে যাওয়া, অন্যদিকে সাহসী পদক্ষেপে রাষ্ট্রকে নতুন করে গড়ে তোলা।
ইতিহাস আমাদের সুযোগ দিয়েছে। এবার সিদ্ধান্ত আমাদের-আমরা কি আবারো প্রতারণার শিকার হব, নাকি নিজের হাতে ভবিষ্যৎ লিখব?

জনগণকে স্বপ্ন দেখানোর সময় শেষ। এখন প্রয়োজন বাস্তব পদক্ষেপ, সংগ্রাম, ঐক্য এবং নতুন রাষ্ট্রচিন্তা। শুধুমাত্র তবেই আমরা মুক্তি ও সমতার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব।