মুসলিম বিশ্বের বিভক্তি,নতুন জোটরাজনীতি ও পশ্চিমা ষড়যন্ত্র:ভারতের মাথানষ্ট-একটি বিপ্লবী বিশ্লেষণ

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
নতুন এক জোট রাজনীতির সূচনা বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে আবারও ভূমিকম্পের মতো এক নতুন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। ইরান, তুরস্ক, কাতার ও আরব আমিরাতের মতো শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যখন ইসরায়েলের সাথে হাত মেলালো-তখন বহু পুরনো ধারণা ভেঙে চূর্ণ হয়ে গেল। ওদিকে পাকিস্তান ও সৌদি আরব ঐক্যবদ্ধ হয়ে যে সামরিক চুক্তি সাক্ষর করেছে, তা দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সমীকরণকে পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে। এরই মধ্যে ওআইসি, আরব লীগ ও মালয়েশিয়া সম্মিলিতভাবে একটি মুসলিম ন্যাটো বাহিনী গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এই ত্রিমুখী অক্ষ-(১) সৌদি-পাকিস্তান সামরিক জোট, (২) ইরান-তুরস্ক-কাতার-আমিরাত-ইসরায়েল সমঝোতা, এবং (৩) মুসলিম ন্যাটো উদ্যোগ-একসাথে বৈশ্বিক রাজনীতিতে অভূতপূর্ব শক্তি ও সংঘাতের জন্ম দিচ্ছে।

এই ঘটনাপ্রবাহে ভারত, ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিগুলো গভীরভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। কারণ মুসলিম বিশ্বের মধ্যে যদি প্রকৃত ঐক্য গড়ে ওঠে, তবে তাদের দীর্ঘদিনের “ডিভাইড অ্যান্ড রুল” কৌশল ভেস্তে যাবে।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটঃ শিয়া-সুন্নী বিভাজনের আগুন
আমরা যদি ইতিহাসের পাতা উল্টাই, দেখা যায় মুসলিম বিশ্বের অভ্যন্তরে বিভক্তি সৃষ্টি করার জন্য বহিরাগত শক্তিগুলো বরাবরই ষড়যন্ত্র করেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা অটোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আরবদের উসকে দিয়েছিল। পরে ফরাসি ও ব্রিটিশ কূটনীতিক সাইকস–পিকো চুক্তির মাধ্যমে আরব ভূখণ্ডকে কেটে–ছেঁটে কৃত্রিম রাষ্ট্র বানানো হয়। আর আধুনিক কালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমারা শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্বকে এমনভাবে প্রলেপ দিয়েছে, যেন মুসলমানরা নিজেরাই নিজেদের সবচেয়ে বড় শত্রু।

ইরাক যুদ্ধ, সিরিয়া সংঘাত, ইয়েমেন যুদ্ধ-সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, বাইরের শক্তিগুলো অভ্যন্তরীণ সেক্টারীয় বিভাজনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। শিয়া বনাম সুন্নী-এই তত্ত্বকে তারা এতই ভয়াবহভাবে প্রচার করেছে যে, মুসলিম জাতিগুলো আসল শত্রুকে ভুলে গিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে রক্ত ঝরিয়েছে।

কিন্তু এর আড়ালে কারা লাভবান হয়েছে? অস্ত্র বিক্রেতা পশ্চিমা কোম্পানিগুলো, তেল লুটে নেওয়া বহুজাতিক কর্পোরেশন, আর ভূরাজনৈতিক আধিপত্য কায়েম করা যুক্তরাষ্ট্র–ইসরায়েলি অক্ষ।
পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্রঃ বিভেদের আড়ালে লুটপাট
আজ আমরা দেখছি-পশ্চিমারা মুসলমানদের বিভক্ত রাখতে সবকিছু করছে। গণমাধ্যম থেকে থিঙ্ক ট্যাঙ্ক পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে তারা প্রচার করছে-“শিয়া আর সুন্নী কখনও এক হতে পারবে না।” এই বিভাজনকে টিকিয়ে রাখাই তাদের বিজয়ের মূলমন্ত্র।

তারা জানে, যদি মুসলিম বিশ্বে ৫৭টি দেশ একসাথে দাঁড়িয়ে যায়, তবে অর্থনীতি, সামরিক শক্তি ও ভূরাজনীতিতে আর কেউ মুসলমানদের থামাতে পারবে না। কারণ-মুসলিম বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করে বৈশ্বিক জ্বালানি রিজার্ভের প্রায় ৬০%।
বিশ্বের সবচেয়ে কৌশলগত বন্দর ও সমুদ্রপথ মুসলিম দেশগুলোর হাতে। যুবক ও শ্রমশক্তির দিক থেকে মুসলিম সমাজই সবচেয়ে সমৃদ্ধ।

কিন্তু ঐক্যহীনতা ও বিভক্তিই পশ্চিমাদের লুটপাটকে সম্ভব করেছে। ফলে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া-সব দেশকে ধ্বংসের স্তুপে পরিণত করেছে তারা। আর একইসাথে মুসলমানদের এমনভাবে বিভ্রান্ত করেছে যে, আমরা একে-অপরকেই শত্রু ভেবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি।

সৌদি-পাকিস্তান জোটঃ ভারতের ঘুম হারাম
এই প্রেক্ষাপটে সৌদি আরব ও পাকিস্তানের সামরিক জোট ভারতকে ভীষণভাবে চিন্তিত করে তুলেছে। পাকিস্তান বরাবরই ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী। তার উপর সৌদির বিপুল আর্থিক শক্তি যদি পাকিস্তানের সামরিক মেশিনারির সাথে যুক্ত হয়, তবে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের আধিপত্য প্রশ্নের মুখে পড়বে।

ইতিহাস বলে-১৯৭১ সালে পাকিস্তান একা ছিল, তাই বাংলাদেশকে ঠেকাতে পারেনি। কিন্তু আজ যদি সৌদি তহবিল, পাকিস্তানি সেনা, এবং অন্যান্য মিত্রশক্তি একত্রিত হয়, তবে ভারতকে শুধু সীমান্তে নয়, অভ্যন্তরেও প্রতিরোধ করতে হবে। এজন্যই ভারত এখন মার্কিন ও ইসরায়েলি প্রযুক্তি আমদানিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

ইরান-তুরস্ক-কাতার-আমিরাত-ইসরায়েল অক্ষঃ এক অদ্ভুত সমঝোতা
অন্যদিকে ইরান ও তুরস্কের মতো ঐতিহ্যগত প্রতিদ্বন্দ্বীরা যখন ইসরায়েলের সাথে কৌশলগত সমঝোতায় গেল, তখন অনেকেই হতবাক হয়েছে। আরব আমিরাত এর আগেই আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছিল। কাতারও দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি মেনে নিয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে-এই অক্ষের প্রকৃত লক্ষ্য কী?
অনেকে বলছেন, এটি আসলে ইরানের জন্য এক কূটনৈতিক কৌশল-যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে টিকে থাকার জন্য। আবার তুরস্কও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোর কাছে ব্যর্থ হয়ে এখন ভিন্ন পথে হাঁটছে।
তবে মুসলিম বিশ্বের সাধারণ মানুষ এটিকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবেই দেখছে। কারণ ইসরায়েল এখনও ফিলিস্তিনি জনগণের দখলদার। অথচ কিছু মুসলিম রাষ্ট্র নিজেদের আঞ্চলিক স্বার্থে সেই ইসরায়েলের হাত ধরছে।

মুসলিম ন্যাটো বাহিনীঃ ঐক্যের এক ঝলক
সবচেয়ে আলোচিত উদ্যোগ হলো-ওআইসি, আরব লীগ ও মালয়েশিয়ার নেতৃত্বে যৌথ মুসলিম ন্যাটো বাহিনী গঠন। যদি সত্যিই এই বাহিনী কার্যকর হয়, তবে এটি হবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক জোট। ভাবুন-তেল-গ্যাসের অর্থায়নে প্রশিক্ষিত সেনা, আধুনিক অস্ত্র, এবং ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক সংকল্প। তখন ফিলিস্তিন প্রশ্নে কিংবা কাশ্মীর ইস্যুতে মুসলিম বিশ্ব একসাথে অবস্থান নিতে পারবে। তখন আর কোনো পশ্চিমা শক্তি এককভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।

কিন্তু এখানেও প্রশ্ন-কে নেতৃত্ব দেবে? সৌদি না তুরস্ক? পাকিস্তান না ইরান? এই নেতৃত্ব সংকট মিটলেই কেবল মুসলিম ন্যাটো বাস্তবতা পাবে।
বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপট
আমাদের বাংলাদেশের জন্য এই জোটরাজনীতির গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ-আমরা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ।আমাদের শ্রমশক্তি মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। ভূরাজনৈতিকভাবে ভারত মহাসাগরের বুকে বাংলাদেশ হলো এক কৌশলগত প্রবেশদ্বার।

তাই বাংলাদেশের নেতৃত্বকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে-আমরা কি কেবল ভারত ও পশ্চিমাদের স্বার্থরক্ষাকারী হব, নাকি মুসলিম বিশ্বের ঐক্য গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা রাখব?
আমরা যদি সৌদি-পাকিস্তান অক্ষ কিংবা মুসলিম ন্যাটো উদ্যোগে সক্রিয় অংশগ্রহণ করি, তবে অর্থনীতি থেকে প্রতিরক্ষা-সবক্ষেত্রেই নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। আর যদি নিরপেক্ষতার নামে নীরব থাকি, তবে অন্যের খেলায় আমরা কেবল ভুক্তভোগী হব।

বিপ্লবী আহ্বানঃ ঐক্যের পথে অগ্রযাত্রা
আজ সময় এসেছে, মুসলমানদের জন্য একটি মৌলিক উপলব্ধি জাগিয়ে তোলার। পশ্চিমারা যতদিন শিয়া–সুন্নী বিভাজন ছড়িয়ে দিয়েছে, ততদিন আমরা নিজেদেরই ধ্বংস করেছি। এখন আর সময় নেই এই ষড়যন্ত্রে আটকে থাকার।
আমাদের বুঝতে হবে-
ফিলিস্তিনের শিশুর রক্ত শিয়া-সুন্নী আলাদা করে পড়ে না।
কাশ্মীরের বন্দী তরুণীর আর্তনাদে কোনো মাযহাব নেই।
ইয়েমেন, সিরিয়া, লিবিয়া, আফগানিস্তানের ধ্বংসস্তূপ সব মুসলমানের জন্য এক যৌথ শোক। তাহলে কেন আমরা এখনও বিভক্ত? কেন আমরা এখনও নিজেদের শত্রু ভেবে লড়ছি?

আজ দরকার-
১. শিক্ষা বিপ্লব: ইতিহাসের সত্য শেখানো, বিভাজন নয়।
২. অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা: তেলের অর্থে অস্ত্র কেনা নয়, বরং প্রযুক্তি ও গবেষণায় বিনিয়োগ।
৩. রাজনৈতিক ঐক্য: জাতীয়তাবাদ নয়, উম্মাহর ঐক্য।
৪. সামরিক শক্তি: মুসলিম ন্যাটো বাহিনীকে কার্যকর করা।

ঐক্যই আমাদের অস্ত্র:পশ্চিমারা যতদিন আমাদের বিভক্ত রাখবে, ততদিন তাদের হাতে আমরা ক্রীতদাসই থাকব। কিন্তু যদি মুসলিম বিশ্ব আজ একসাথে দাঁড়িয়ে যায়, তবে পৃথিবীর মানচিত্র পাল্টে যাবে। স্মরণ রাখতে হবে-ঐক্যই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিরক্ষা, সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্র, সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লব। আমাদের বিপ্লব শুরু হবে বিভাজনের শৃঙ্খল ভেঙে ঐক্যের পতাকা উড়িয়ে।

আজকের এই নতুন জোটরাজনীতি আমাদের সামনে এক দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এটি আমাদের জন্য সতর্কবার্তা-আবারো বিভক্ত হলে ধ্বংস হব, ঐক্যবদ্ধ হলে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেব। এটাই হোক বাংলাদেশের যুবকদের জন্য নতুন শপথ-শিয়া-সুন্নী নয়, মুসলমান মানেই এক। বিভক্তির রাজনীতি ভেঙে ঐক্যের বিপ্লব গড়ে তুলতে হবে। আর সেই বিপ্লবের অঙ্গীকারই হবে ২১শ শতকের মুসলিম বিশ্বের মুক্তির অঙ্গীকার।

লেখক: সম্পাদক-নবজাগরণ।
অনলাইনে পড়তে:www.thenabajagaran.com