জুলাই সনদ:বিপ্লবের রক্তের দায় ও আইনী স্বীকৃতির অনিবার্যতা

নবজাগরণ ডেস্ক:
বাংলাদেশ রাষ্ট্র ৫৩ বছরের পথচলায় আজ এক সঙ্কটময় মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। বিগত অর্ধশতকে যারা সরকার গঠন করেছে-তাদের প্রত্যেকের হাতেই রক্ত, লুটপাট, বঞ্চনার ইতিহাস। জনগণ একের পর এক প্রতারিত হয়েছে। বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে মুক্তির, কিন্তু মিলেছে কেবল নতুন শৃঙ্খল।

২০২৪ সালের জুলাই-আগষ্টে যে অভ্যুত্থান ঘটেছে, সেটি এই রাষ্ট্রের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব অধ্যায়। এই অভ্যুত্থান ছিল জনগণের, ছাত্র-যুবকের, শ্রমিক-কৃষকের। কোনো রাজনৈতিক দলের নয়। এই অভ্যুত্থান রক্তের বিনিময়ে জুলাই সনদ সৃষ্টি করেছে। সেই সনদ স্পষ্ট করে দিয়েছে: রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, আর জনগণের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে-জুলাই সনদ কি আইনী স্বীকৃতি পাবে? নাকি আবারও ষড়যন্ত্র করে বিপ্লবকে দমিয়ে ফেলা হবে?
৫৩ বছরের অপরাধের ইতিহাস
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত যেসব রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে, তাদের ইতিহাস এক কথায় প্রতারণার ইতিহাস।

১৯৭২-১৯৭৫: মুক্তিযুদ্ধের পর গড়ে উঠল নতুন প্রজাতন্ত্র। কিন্তু জনগণের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার বদলে দলীয়করণ ও একদলীয় শাসনের বীজ বপন করা হলো। ১৯৭৫ সালে বাকশাল চাপিয়ে দেওয়া হলো জনগণের ওপর।
১৯৭৫-১৯৯০: সেনাশাসন, সামরিক জান্তা ও দলতন্ত্র। জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হলো। সংবিধানকে খেলনার মতো ব্যবহার করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার প্রতিযোগিতা চলল।
১৯৯১-২০০৮: বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে পালাবদলের নাটক। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ হয়ে লুটপাট, দুর্নীতি ও দমননীতি চালিয়ে গেল।

২০০৯-২০২৪: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র দুঃশাসন। প্রহসনের নির্বাচন, গুম-খুন, গণহত্যা, দমন-পীড়ন-রাষ্ট্রকে পরিণত করল এক স্বৈরতান্ত্রিক কারাগারে।জনগণ কেন তাদের বিশ্বাস করবে?
৫৩ বছরের ইতিহাসে এমন একটি উদাহরণও নেই যেখানে জনগণের অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে। বরং প্রতিটি সরকার রাষ্ট্র কাঠামোকে ভঙ্গুর করে তুলেছে, পরিবারতন্ত্র ও আমলাতন্ত্রের হাতে তুলে দিয়েছে।

জুলাই বিপ্লব: জনগণের রক্তে লেখা সনদ ২০২৪ সালের জুলাইয়ে শিক্ষার্থী-যুবকদের আন্দোলন দ্রুত রূপ নেয় সর্বাত্মক গণঅভ্যুত্থানে। প্রজন্মের পর প্রজন্মের ক্ষোভ, চাকরি ও শিক্ষায় বৈষম্য, গুম-খুনের ভয়াবহতা, অর্থনৈতিক লুটপাট-সব মিলিয়ে ফেটে পড়ে আগুন। কয়েক সপ্তাহেই প্রাণ দিয়েছে হাজারো ছাত্র-যুবক। লক্ষাধিক আহত, হাজারো মানুষ জেলে গেছে।নারী-পুরুষ, গ্রামীণ-শহুরে সব শ্রেণির মানুষ জেগে ওঠে। এই রক্তের স্রোত থেকেই জন্ম নেয় জুলাই সনদ।সেই সনদ স্পষ্ট করে:পরিবারতন্ত্র ও রাজতন্ত্র ভেঙে ফেলতে হবে।রাষ্ট্রের মালিক জনগণ।
রাষ্ট্র ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হবে জনগণের হাতে। এটি কোনো রাজনৈতিক নেতার দান নয়, বরং শহীদ ছাত্র-যুবকের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ঐতিহাসিক ঘোষণা।

কেন জুলাই সনদ পাশ কাটিয়ে নির্বাচন মানে ষড়যন্ত্র
আজ আবারো শোনা যাচ্ছে নির্বাচন আয়োজনের কথা। কিন্তু জুলাই সনদের চূড়ান্ত স্বীকৃতি ছাড়া নির্বাচন মানে কী?
এটি মানে-বিপ্লবকে অসম্পূর্ণ রেখে দেওয়া। পরিবারতন্ত্র ও আমলাতন্ত্রকে পুনর্বাসন করা। জনগণের আত্মত্যাগকে উপহাস করা। রাজনৈতিক দলগুলোর নতুন করে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রকে বৈধতা দেওয়া। আমরা ইতিহাস থেকে জানি-অসম্পূর্ণ বিপ্লব মানে প্রতারণা। ফরাসি বিপ্লব, রাশিয়ান বিপ্লব কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার মুক্তি আন্দোলন-সব ক্ষেত্রেই দেখা গেছে জনগণের রক্তকে পাশ কাটাতে গেলে সেই রাষ্ট্র আবারও অন্ধকারে তলিয়ে গেছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একমাত্র কর্তব্য-
ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন ইতিহাসের এক মহাসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।
জনগণ তাদের গ্রহণ করেছে শুধুমাত্র এক কারণে-তারা জুলাই বিপ্লবের পরিণতি হিসেবে এসেছে। তাই তাদের বৈধতা নির্ভর করছে একটিমাত্র শর্তের ওপর: জুলাই সনদের চূড়ান্ত আইনী স্বীকৃতি। এর বাইরে কোনো পথ নেই।গণভোট বিল পাস করতে হবে। জনগণকে রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে আইনীভাবে ঘোষণা করতে হবে। নতুন নির্বাচনী কাঠামো সেই ভিত্তিতে নির্মাণ করতে হবে।

সংবিধান পরিবর্তনের যুক্তি:অনেকে বলে-সংবিধানে তো এভাবে পরিবর্তনের সুযোগ নেই। আমরা বলি:সংবিধান মানব রচিত। মানব রচিত কোনো কিছুই চূড়ান্ত নয়। ইতিহাসের উদাহরণ:ফ্রান্স: ১৭৮৯ সালের বিপ্লবের পর একাধিকবার নতুন সংবিধান। রাশিয়া: ১৯১৭ সালের বিপ্লবের পর সম্পূর্ণ নতুন কাঠামো। দক্ষিণ আফ্রিকা: বর্ণবাদের অবসানের পর জনগণনির্ভর নতুন সংবিধান।তাহলে বাংলাদেশের জনগণের রক্ত কি কম মূল্যবান? মানব রচিত সংবিধান যদি জনগণের মুক্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তবে সেই সংবিধানই পরিবর্তন করতে হবে।

জনগণের প্রতি প্রশ্ন-প্রিয় বাংলাদেশবাসী,৫৩ বছর ধরে আপনাকে বারবার প্রতারিত করা হয়েছে।প্রশ্ন হলো-আবারও কি আপনি সেই প্রতারকদের বিশ্বাসকরবেন?নাকি বিশ্বাস করবেন নিজের রক্ত, নিজের সন্তানদের আত্মত্যাগকে?যদি জুলাই সনদ আইনী স্বীকৃতি না পায়, তবে আসন্ন নির্বাচন হবে আরেকটি প্রতারণা। তখন আপনার রক্তের দাম শূন্যে পরিণত হবে।

নতুন রাষ্ট্র কাঠামোর রূপরেখা-
জুলাই সনদের বাস্তবায়ন মানে হলো-জনগণ রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক। রাজনৈতিক দল নয়, জনগণের গণভোট হবে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের মূল উৎস।পরিবারতন্ত্র, রাজতন্ত্র, আমলাতন্ত্র ধ্বংস হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, বিচার-সব মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে। লুটপাট, দুর্নীতি, বৈষম্যের বিরুদ্ধে জবাবদিহিমূলক কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হবে। এটাই হবে নতুন বাংলাদেশ-একটি সত্যিকারের জনগণের প্রজাতন্ত্র।

সতর্কবার্তা:আমরা স্পষ্ট করে বলি-যদি জুলাই সনদ আইনী স্বীকৃতি না পায়, তবে জনগণের রোষ থামানো যাবে না। এই জনগণ একবার রক্ত দিয়ে রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙে ফেলেছে, আবারো করবে। এইবার প্রতিরোধ হবে আরও প্রবল, আরও ভয়ঙ্কর।

ইতিহাসের দায়-ড. মুহাম্মদ ইউনূস,আপনার হাতে আজ বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব। আপনি পারবেন-জনগণকে তাদের রাষ্ট্র ফিরিয়ে দিতে, বিপ্লবকে চূড়ান্ত করতে,ইতিহাসে চিরকাল বেঁচে থাকতে। কিন্তু যদি ব্যর্থ হন, তবে ইতিহাস আপনাকে ক্ষমা করবে না।
অতএব আর দেরি নয়-এখনই জুলাই সনদের আইনী স্বীকৃতি দিন। গণভোট বিল পাস করুন। জনগণকে রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দিন। কারণ এটাই মুক্তির একমাত্র পথ। বিপ্লবের রক্ত বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না।

লেখক: মো: আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক ও প্রকাশক
সাপ্তাহিক নবজাগরণ

শেয়ার করে ছড়িয়ে দিন-প্রকাশনার ৪ যুগে পদার্পণ।
অনলাইনে পড়তে:www.thenabajagaran.com