মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
সাম্রাজ্যবাদের অদ্ভুত খিদে-আমেরিকা পৃথিবীর ইতিহাসে এক অনন্য জাতি-নিজেকে “গণতন্ত্রের অভিভাবক” বলে দাবি করে, অথচ বারবার প্রমাণ করেছে, তার আসল চরিত্র হলো সামরিকতন্ত্র ও লুটপাটের পৃষ্ঠপোষকতা। আমেরিকার রাষ্ট্রপতিরা একে একে যুদ্ধের আগুন জ্বালিয়েছেন-ভিয়েতনাম, ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া-তালিকা দীর্ঘ।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর সেই সাম্রাজ্যবাদী খেলায় নতুন এক “বেপরোয়া ও হাস্যকর ধাঁচ” যোগ হলো। তিনি কখনো কানাডাকে দখল করে আমেরিকার প্রদেশ বানানোর খায়েশ প্রকাশ করেন, কখনো গ্রীনল্যান্ড কেনার চেষ্টা করেন, কখনো পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কথা বলেন। গাজার উপকূলে রিয়েল এস্টেট বানানোর স্বপ্ন দেখেন, আবার হঠাৎ করে আফগানিস্তানের বাগরাম ঘাঁটি ফেরত পাওয়ার জন্য হুমকি দেন।
এইসব কর্মকাণ্ড কেবল ট্রাম্পের ব্যক্তিগত অদ্ভুত চরিত্রের প্রতিফলন নয়, বরং আমেরিকার রাষ্ট্রীয় প্রবণতারই প্রতিচ্ছবি-বিশ্বের যে কোনো অঞ্চলে অযথা প্রবেশ, দখল, শোষণ, আর শেষে ব্যর্থ হয়ে পালানো। ট্রাম্পের “রিয়েল এস্টেট কূটনীতি”: কানাডা থেকে গ্রীনল্যান্ড ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অনেকে কেবল এক রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী হিসেবে চেনে, কিন্তু তার রাষ্ট্রপতিত্বকালে দেখা গেল তিনি কূটনীতিকও হতে চান একই ব্যবসায়ী মানসিকতায়।
কানাডা দখল: পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ, আমেরিকার থেকেও বড় আয়তনের কানাডাকে তিনি আমেরিকার “একটি প্রদেশ” করার স্বপ্ন দেখলেন।
গ্রীনল্যান্ড কেনা: তিনি প্রকাশ্যে প্রস্তাব দিলেন, আমেরিকা গ্রীনল্যান্ড কিনে নেবে। ডেনমার্ক তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করল, অথচ তিনি রাগ করে কূটনৈতিক সফর বাতিল করলেন। পানামা খাল: শতবর্ষ আগে যার নিয়ন্ত্রণ আমেরিকা দিয়েছিল, সেটি ফেরত নেওয়ার হুমকি দিলেন।
এইসব দাবির মধ্যে একধরনের গুন্ডামি আছে-যেন রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোনো সন্ত্রাসী অন্যের সম্পত্তি দখল করতে চায়।
গাজার রিয়েল এস্টেট স্বপ্ন বনাম বাস্তবতা ট্রাম্প প্রকাশ্যে বলেছিলেন, গাজার সমুদ্রতটে তিনি দালানকোঠা, শপিংমল, রিসোর্ট বানাতে চান। যেন প্যালেস্টাইনের রক্তাক্ত ভূমিকে তিনি “ট্রাম্প টাওয়ার” বানানোর ব্যবসায়িক ক্যানভাসে রূপ দেবেন।
কিন্তু বাস্তবতা এত সহজ ছিল না। প্যালেস্টাইন-ইসরায়েল সংঘাত, আন্তর্জাতিক আইন, মুসলিম বিশ্বের ক্ষোভ-এসবের কারণে ট্রাম্প বেশি দূর এগোতে পারেননি। গাজার নাম নিয়ে সামান্য আওয়াজ তুললেও পরে চুপ মেরে গেলেন।
বাগরাম এয়ার বেইস: ট্রাম্পের নতুন টার্গেট
আফগানিস্তানের বাগরাম এয়ার বেইস হলো আমেরিকার সবচেয়ে বড় ঘাঁটি, যেটি ২০০১ থেকে ২০২১ পর্যন্ত দুই দশক ব্যবহৃত হয়। এখান থেকেই তালেবান বিরোধী অভিযান, ড্রোন হামলা, গোয়েন্দা তৎপরতা-সব পরিচালিত হতো। ২০২১ সালে আমেরিকা যখন লজ্জাজনকভাবে আফগানিস্তান ছাড়ে, তখন বাগরাম ছেড়ে যেতে হয়। কিন্তু এখন ট্রাম্প বলছেন-তিনি আবারও বাগরামে ফিরবেন!
কেন বাগরাম এত গুরুত্বপূর্ণ? পাকিস্তানের দীর্ঘপাল্লার মিসাইল আবাবীল সহজেই ইসরায়েলে আঘাত হানতে পারে।
সৌদি আরব-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়েছে। প্রয়োজনে পাকিস্তান সৌদির হয়ে লড়তে পারে। ইসরায়েলের নিরাপত্তা তাই হুমকির মুখে।বাগরাম ঘাঁটি থেকে পাকিস্তানি মিসাইল ঠেকানোর জন্য কার্যকর রাডার ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা স্থাপন সম্ভব। অর্থাৎ, আমেরিকার ফেরার আসল কারণ চীন নয়, বরং ইসরায়েল। সৌদি-পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি: আরব দুনিয়ার নতুন সমীকরণ
২০২৫ সালের শুরুতে সৌদি আরব পাকিস্তানের সাথে প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এটি কোনো হঠাৎ সিদ্ধান্ত নয়-প্রায় দুই বছরের আলোচনা শেষে এই চুক্তি হয়েছে।
ইসরায়েল যখন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বাধা দিল, আর হামাসের সন্ত্রাসী হামলা পরিস্থিতি আরও জটিল করল, তখন থেকেই সৌদি আরব নতুন বিকল্প খুঁজছিল। আমেরিকার ওপর ভরসা না করে পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়া সেই বিকল্প।
এই চুক্তির মাধ্যমে-সৌদি আরব পাকিস্তানি রাডার, মিসাইল ও প্রতিরক্ষা ছাতার আওতায় আসবে। পাকিস্তান তার অস্ত্রশক্তি দিয়ে ইসরায়েলকে সরাসরি হুমকির মুখে ফেলতে পারবে। আমেরিকার একচ্ছত্র প্রভাব ভেঙে পড়বে।
আফগানিস্তান যুদ্ধের মহাখরচ আমেরিকা আফগানিস্তানে ২০ বছর যুদ্ধ করেছে। এর খরচ এককথায় ভয়াবহ।
প্রাণহানি: নিয়মিত সেনা নিহত ২,৩২৪ জন, কন্ট্রাক্টর নিহত ৩,৯১৭ জন, আহত ২০,৭৬৯ জন। টাকা: আনুমানিক ব্যয় ৪ থেকে ৬ ট্রিলিয়ন ডলার। ফলাফল: তালেবানকে পরাজিত করতে পারেনি, বরং তারা আবার ক্ষমতায় এসেছে। এই ব্যর্থতার পরও ট্রাম্প যদি বাগরামে ফেরার পরিকল্পনা করেন, তবে এটি আরেকটি “ফুটো কলস প্রজেক্ট” ছাড়া কিছু নয়।
চীনের অজুহাত বনাম ইসরায়েলের খেদমত
বিশ্লেষকরা বলেন, আমেরিকা বাগরামে ফেরার কথা বলছে চীনের মোকাবেলায়। কিন্তু এটি কেবল অজুহাত।
বাস্তবে আমেরিকার আর চীনের সাথে সরাসরি যুদ্ধ করার সামর্থ নেই। চীন অর্থনীতি, প্রযুক্তি, সামরিক শক্তি-সবক্ষেত্রেই শক্তিশালী। তাই আসল উদ্দেশ্য হলো ইসরায়েলকে রক্ষা করা। অতএব, “চীনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ” কথাটি জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য, আর ভেতরে ভেতরে ইসরায়েলের খেদমতই আসল কাজ।
ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু: দুই প্রান্তের পতন
ট্রাম্প নিজ দেশে নানা কেলেঙ্কারি, অভিশংসন, আদালতের মামলা নিয়ে টালমাটাল। নেতানিয়াহুর দিনও ফুরিয়ে আসছে-ইসরায়েলি জনগণ তার নীতিতে ক্লান্ত। এমন পরিস্থিতিতে তারা দুজনই নিজেদের রাজনৈতিক জীবন বাঁচাতে নতুন যুদ্ধ, নতুন সংকট তৈরি করতে চান।
আরব দুনিয়ার সম্ভাব্য বিস্ফোরণ
যদি আবারও আরব দুনিয়া লড়াইয়ে নামে, তবে ইতিহাস ঘুরে দাঁড়াতে পারে। হয়তো একদিন-“জর্ডান নদী তীর থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত প্যালেস্টাইনের পতাকা উড়বে।”ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, দখলদার কখনো স্থায়ী হয় না। আমেরিকার দখল, ইসরায়েলের দখল-সবই একদিন ভেঙে পড়বে।
আব্রাহাম লিংকনের শিক্ষা বনাম ট্রাম্পের চরিত্র-
এখানে আব্রাহাম লিংকনের এক ঘটনার কথা মনে করা যায়। তাকে যখন “মুচির ছেলে” বলে অপমান করা হয়েছিল, তিনি গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন-“আমার বাবা ছিলেন নিপুণ জুতা প্রস্তুতকারক, আমি চাইলে আপনাকেও জুতা বানিয়ে দিতে পারি।”লিংকনের এই বিনয়, আত্মসম্মান ও সততা তাকে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক করেছে।
কিন্তু ট্রাম্পের চরিত্র তার উল্টো। তিনি অহংকারী, বেপরোয়া, হুমকি দিয়ে কথা বলেন, সত্য গোপন করেন, এবং রাষ্ট্রকে ব্যবসায়ের মতো চালাতে চান। এই দুই ব্যক্তিত্বের তুলনা করলেই বোঝা যায়, কেন আমেরিকা আজ শান্তির বদলে যুদ্ধের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বশান্তির অন্তরায়:
বিশ্বশান্তির সবচেয়ে বড় অন্তরায় হলো-
১. আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী নীতি।
২. ইসরায়েলের দখলদারিত্ব।
৩. যুদ্ধবাজ রাজনীতিকদের ক্ষমতার লালসা।
ট্রাম্পের বাগরাম ঘাঁটি ফেরত নেওয়ার চেষ্টা আসলে নতুন করে বিশ্বকে রক্তে ভাসানোর ইঙ্গিত। কিন্তু ইতিহাস প্রমাণ করে, সাম্রাজ্যবাদ যত শক্তিশালী হোক না কেন, মানুষের মুক্তির সংগ্রাম একদিন বিজয়ী হবেই।
লেখক: মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক
নবজাগরণ
অনলাইনে পড়তে:www.thenabajagaran.com