মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
খাগড়াছড়িতে সেনা সদস্যকে দুই ঘণ্টা আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন: কী হচ্ছে পাহাড়ে?
খাগড়াছড়ির সাম্প্রতিক ঘটনা গোটা জাতিকে নাড়া দিয়েছে। প্রকাশ্যে দেখা গেল-দায়িত্ব পালনরত সেনা সদস্যকে পাহাড়িরা ঘেরাও করে, লাঠিসোঁটা দিয়ে পিটিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। শুধু তাই নয়, প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যমতে, তাঁকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং টানা দুই ঘণ্টা আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়। সেনা সদস্যকে পরবর্তীতে উদ্ধার করা হলেও তাঁর অবস্থা তখন ছিল অত্যন্ত গুরুতর ও ক্রিটিকাল।
এমন একটি ঘটনার ছবি ও ভিডিও ইতিমধ্যেই সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, যা সাধারণ মানুষকে ক্ষোভ ও হতাশায় ফেলে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠছে-
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যাদের নিরাপত্তা ও শান্তি রক্ষায় দিনরাত কাজ করছে, তাদের ওপরই যদি এভাবে হামলা হয়, তাহলে পাহাড়ের আইন-শৃঙ্খলার অবস্থা কোন দিকে যাচ্ছে? কারা পাহাড়ে এই সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের নেপথ্যে কাজ করছে?
বিদেশি স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা তৎপরতা ও স্থানীয় দেশবিরোধী চক্র কি তবে পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্তে নেমেছে?
এটি কেবল একজন সেনা সদস্যের ওপর হামলা নয়-এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার ওপর সরাসরি আঘাত। খাগড়াছড়ির মাটিতে যারা এ ধরনের বর্বরতা চালাচ্ছে, তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট: সেনা-প্রশাসনকে দুর্বল করা, জনগণের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি করা এবং পাহাড়ে রাষ্ট্রের উপস্থিতি প্রশ্নবিদ্ধ করা।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব এখন- অবিলম্বে হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনা, সাম্প্রদায়িক উস্কানিদাতাদের চিহ্নিত করা,
এবং পাহাড়ে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
আমরা ভুলে গেলে চলবে না-সেনাবাহিনী দেশের গর্ব, আর এ বাহিনীর ওপর হামলা মানে পুরো জাতির ওপর হামলা। খাগড়াছড়ির এই ভয়াবহ ঘটনাই প্রমাণ করছে, পাহাড়ে একটি চিহ্নিত অপশক্তি সক্রিয় রয়েছে, যারা বারবার অস্থিরতা সৃষ্টি করে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাতে চাইছে। এখনই সময়-সকল দেশপ্রেমিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর। পাহাড়ের শান্তি, উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় কোনো আপস নয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে এসেও পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্ত হয়নি। একদিকে উন্নয়ন, অপরদিকে ষড়যন্ত্র-এ দুটি যেন পাশাপাশি চলে। সম্প্রতি খাগড়াছড়িতে যে দৃশ্য বাংলাদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে, তা কেবলই একটি সহিংস ঘটনা নয়, বরং রাষ্ট্রের অস্তিত্বে আঘাত হানার স্পষ্ট বার্তা। সেনা সদস্যকে প্রকাশ্যে লাঠি দিয়ে আক্রমণ, মাটিতে ফেলে দেওয়া, অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা-এগুলো নিছক আইনশৃঙ্খলার ব্যত্যয় নয়, বরং একটি বৃহত্তর নকশার অংশ।
আজকের বাংলাদেশে প্রশ্ন কেবল একটি অপরাধমূলক ঘটনার শাস্তি নয়; প্রশ্ন হলো-কে বা কারা এমনভাবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে দুর্বল প্রমাণ করতে চাইছে? কোন উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করা হচ্ছে? কেন অপরাধীদের রক্ষায় দেশবিরোধী স্লোগান ওঠে-“বাঙালি হটাও, সেনা হটাও”? এই উপসম্পাদকীয় সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজবে।
১. ঘটনার সারসংক্ষেপ
খাগড়াছড়িতে সাম্প্রতিক সহিংসতার সূত্রপাত হয়েছিল একটি গুরুতর অপরাধমূলক ঘটনার মাধ্যমে-এক অবাঙালি ছাত্রী ধর্ষণের অভিযোগে পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন চাকমা, মারমা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের তরুণরা। কিন্তু দোষীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করে, পরিকল্পিতভাবে দোষ চাপানো হয় বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর।
পরবর্তীতে দেখা যায়-মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানায় হামলা, অন্তত দশটি দোকান লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ, এমনকি সেনাসদস্যদের ওপর প্রকাশ্য আক্রমণ। সেনা সদস্যকে লাঠি দিয়ে আঘাত করার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলে দেশজুড়ে ক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু বিস্ময়ের বিষয়-এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করে কিছু বামপন্থী সংগঠন ও বিদেশপন্থী এনজিও উল্টো সেনা ও বাঙালিদের বিরুদ্ধেই স্লোগান তোলে। এটি ছিল ষড়যন্ত্রের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।
২. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট-
পার্বত্য চট্টগ্রাম সবসময়ই একটি সংবেদনশীল এলাকা। স্বাধীনতার পরপরই শান্তিবাহিনীর উত্থান ঘটে। তাদের স্লোগান ছিল স্বায়ত্তশাসন, কিন্তু পেছনে ছিল বিদেশি মদত। শান্তিচুক্তি হলেও অনেক সশস্ত্র গোষ্ঠী আত্মসমর্পণ করেনি।
এই অঞ্চলে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে সবসময়
টার্গেট হয়েছে। অথচ সেনারা শুধু সামরিক দায়িত্বই পালন করেনি-তারা রাস্তা-ঘাট নির্মাণ করেছে, পাহাড়ি-সমতল সব জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় সহায়তা করেছে, দুর্যোগে জীবন বাজি রেখে পাশে থেকেছে।
তবুও এক শ্রেণির রাজনীতি, বিশেষত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ছত্রছায়ায় থাকা গোষ্ঠীগুলো, সেনাবাহিনীকে “দমনকারী” হিসেবে প্রচারণা চালায়।
৩. সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রের ভূমিকা
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু যুদ্ধের বাহিনী নয়, বরং এটি একটি উন্নয়নমুখী বাহিনী। পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের উপস্থিতি মানে স্কুল, হাসপাতাল, ব্রিজ, রাস্তাঘাট নির্মাণ। পাহাড়ে একমাত্র কার্যকর সেবা পৌঁছে দিয়েছে সেনারা।
কিন্তু দুঃখজনকভাবে, যাদের এ সেবার সুফল ভোগ করার কথা, সেই জনগণের একটি অংশকে ভুল পথে প্ররোচিত করা হচ্ছে। বিদেশি এজেন্টরা চায়-সেনা ও সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি হোক। সেনাকে শত্রু বানানো মানে রাষ্ট্রকেই শত্রু বানানো।
৪. দেশবিরোধী অপশক্তির এজেন্ডা
খাগড়াছড়ির ঘটনার পর যেভাবে “বাঙালি সেটলার হটাও, সেনা হটাও” স্লোগান উঠেছে, তাতে স্পষ্ট বোঝা যায়-এটি একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক কর্মসূচি। এর লক্ষ্য তিনটি:
১. প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করা।
২. বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ভয় দেখানো।
৩. রাষ্ট্রীয় বাহিনীর মনোবল ভেঙে দেওয়া।
এই তিনটি লক্ষ্যই পাকিস্তানপন্থী, ভারতীয় স্বার্থপন্থী ও তথাকথিত মানবাধিকারবাদী বাম গোষ্ঠীর যৌথ ষড়যন্ত্রের প্রতিফলন।
৫. সাম্প্রদায়িক উস্কানি ও বিভাজননীতি
যখন অপরাধী পাহাড়ি সম্প্রদায়ের সদস্য, তখন তাদের পরিচয় গোপন করা হয়। উল্টো মুসলিম বাঙালিদের উপর দোষ চাপানো হয়। এভাবে “সংখ্যালঘু বনাম সংখ্যাগরিষ্ঠ” দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে দেশকে আন্তর্জাতিক মহলে হেয় করা হয়।
এবারও তাই হলো-ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেফতার হলো পাহাড়ি সম্প্রদায়ের তরুণরা, কিন্তু হামলার শিকার হলো মুসলিম মসজিদ, মাদ্রাসা, দোকান এবং সেনাসদস্য। এটি স্পষ্টতই একটি “ব্লেম-শিফটিং ট্যাকটিক”-অপরাধীকে বাঁচাও, নিরীহকে টার্গেট করো।
৬. বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার মিশন
ভারত বহুদিন ধরেই পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিজের প্রভাব বলয়ের মধ্যে রাখতে চায়। মিজোরাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ডের সশস্ত্র আন্দোলনের অভিজ্ঞতা তারা এ অঞ্চলে কাজে লাগিয়েছে।
আজও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এবং তাদের মিত্র কয়েকটি আন্তর্জাতিক এজেন্সি পাহাড়ে সক্রিয়। তাদের মিশন হলো-
পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা।
সেনাবাহিনীকে ‘দমনকারী বাহিনী’ হিসেবে চিত্রিত করা।
আন্তর্জাতিক মহলে “অভ্যন্তরীণ দমননীতি”র অভিযোগ তুলে বাংলাদেশকে কোণঠাসা করা।
এই হামলার ছবি ও ভিডিও ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিদেশি প্রচারণায় ব্যবহার হচ্ছে-যেন বাংলাদেশ সেনা জনগণকে দমন করছে। অথচ বাস্তবতা হলো, সেনা সদস্যই এখানে হামলার শিকার!
৭. রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তা সংকট
সেনা সদস্যের ওপর প্রকাশ্য হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বে সরাসরি আঘাত। একটি রাষ্ট্র যদি তার সেনাকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তবে সেটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুর্বল প্রমাণিত হয়।
এই আক্রমণ শুধু একজন সেনার উপর নয়, বরং বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার উপর। এর মাধ্যমে বার্তা দেওয়া হয়েছে-“রাষ্ট্রের প্রতীককে আঘাত করা সম্ভব।”
করণীয়-রাষ্ট্রের সামনে এখন তিনটি জরুরি কাজ-
১. দ্রুত বিচার: অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় এনে উদাহরণ তৈরি করতে হবে।
২. উস্কানিদাতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা: যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা স্লোগানের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিচ্ছে, তাদের শনাক্ত করে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।
৩. বিদেশি হস্তক্ষেপ মোকাবিলা: গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়াতে হবে, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ জোরদার করতে হবে। আন্তর্জাতিক ফোরামে পরিষ্কার করে বলতে হবে-এটি কোনো জাতিগত দ্বন্দ্ব নয়, বরং অপরাধ দমনের বিষয়।
৪. জনগণকে সচেতন করা: পাহাড়ি ও বাঙালি উভয় জনগোষ্ঠীকে বোঝাতে হবে-শান্তি ও উন্নয়নের একমাত্র পথ হলো ঐক্য, বিভাজন নয়।
খাগড়াছড়ির এই ঘটনা নিছক একটি সহিংসতা নয়, এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ। সেনাকে আক্রমণ মানে রাষ্ট্রকে আক্রমণ। আজ যদি রাষ্ট্র নীরব থাকে, আগামীকাল সার্বভৌমত্বই প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
বাংলাদেশ কারো ষড়যন্ত্রের পরীক্ষাগার নয়। দেশবিরোধী অপশক্তি, বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা ও তাদের দোসরদের স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে-বাংলাদেশের সেনা মানে বাংলাদেশ রাষ্ট্র; সেনাকে আঘাত মানে স্বাধীনতাকে আঘাত। আর স্বাধীনতা রক্ষায় আমরা আপসহীন।
লেখক:মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক ও প্রকাশক
সাপ্তাহিক নবজাগরণ
অনলাইনে পড়তে:www.thenabajagaran.com
সবাই শেয়ার করুন