মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
বাংলাদেশের প্রশাসনিক ইতিহাসে বিভাগ বা জেলা কেবল ভূমি বা প্রশাসনিক একক হিসেবে নয়, বরং এটি জনগণের স্বীকৃতি, সামাজিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার প্রতীক। প্রতিটি বিভাগ স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ, উন্নয়ন এবং সামাজিক সুসংহতি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, নোয়াখালী-যা সমতল ও পার্বত্য অঞ্চলের সংযোগের কেন্দ্রবিন্দু-শুধু ভৌগোলিক কারণে নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রনালয়ে বৃহত্তর নোয়াখালীর তিনজন উপদেষ্টা রয়েছেন-পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, এবং সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী। এছাড়াও, সরকারের সচিব, সাবেক সচিব ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদে স্থানীয় ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ রয়েছেন। এই তিনজন উপদেষ্টা ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়িত্ব ও নেতৃত্বই নির্ধারণ করবে নোয়াখালীবাসীর দীর্ঘ দিনের দাবী বাস্তবায়নের গতিপথ।
নোয়াখালী বিভাগের দাবি নতুন নয়। এটি প্রায় এক দশক ধরে বৃহত্তর নোয়াখালীবাসীর মুখে উচ্চারিত হচ্ছে, সভা, সমাবেশ এবং আন্দোলনের মাধ্যমে। তবে শুধু উচ্চারণ যথেষ্ট নয়। দাবীকে কার্যকর পদক্ষেপে রূপ দিতে হলে সরকারের ভিতরে থাকা প্রভাবশালী উপদেষ্টা ও কর্মকর্তাদের সক্রিয় উদ্যোগ অপরিহার্য।
নোয়াখালী বিভাগের প্রয়োজনীয়তা-
নোয়াখালী শুধুমাত্র প্রশাসনিক সুবিধার কারণে গুরুত্বপূর্ণ নয়। এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক উন্নয়নে। বৃহত্তর নোয়াখালীর-নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী-মধ্যবর্তী যোগাযোগ, শিল্প, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও প্রসার নোয়াখালী বিভাগের মাধ্যমে সহজতর হবে।
বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রশাসনিকভাবে নোয়াখালী জেলা যখন বৃহত্তর বিভাগে অন্তর্ভুক্ত, তখন স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্প, শিক্ষাব্যবস্থা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং সামাজিক নীতি প্রণয়নে স্থানীয় জনগণ দূর্বল অবস্থানে থাকে। এটি প্রমাণ করে, নোয়াখালী বিভাগের গঠন কেবল প্রশাসনিক নয়, এটি জনগণের অধিকার, স্বীকৃতি এবং উন্নয়নের চাবিকাঠি।
নোয়াখালী বিভাগের প্রশাসনিক গুরুত্ব ছাড়াও, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে এটি অপরিহার্য। নোয়াখালীতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বসবাস, ঐতিহ্য এবং শিল্প-সংস্কৃতি রয়েছে, যা সামাজিক ঐক্য ও স্থানীয় স্বীকৃতির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। প্রশাসনিক কেন্দ্রের অভাবে স্থানীয় জনগণ প্রায়ই ন্যায্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়, যা সামাজিক অমর্যাদা ও অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি করে।
উপদেষ্টাদের প্রত্যাশিত ভূমিকা-
নোয়াখালীবাসী শুধু প্রশাসনিক বিভাগ চাইছে না; তারা চায় সুশাসন, উন্নয়ন এবং সামাজিক স্বীকৃতি। এ লক্ষ্যে উপদেষ্টাদের ভূমিকা বহুমাত্রিক।
১. নৈতিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব: পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ নোয়াখালী অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মানচিত্র বিশ্লেষণ করে নীতিমালা প্রণয়নে সরকারের কাছে সুপারিশ দিতে পারেন। তাঁর নেতৃত্বে বিভাগ গঠনের সম্ভাব্য রূপরেখা ও প্রভাব চিহ্নিত করা সম্ভব।
২. তথ্য-ভিত্তিক প্রচার ও জনমত সংযোগ: তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম সরকারি তথ্য, পরিসংখ্যান ও কৌশলগত পরিকল্পনা সমন্বয় করে নোয়াখালীবাসীর সঠিক দাবী ও সরকারি অগ্রগতি জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন। তিনি সরকারের সামনে বাস্তবসম্মত প্রমাণ ও বিশ্লেষণ উপস্থাপন করতে পারবেন।
৩. সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সমন্বয়: সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী নোয়াখালীর ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সামাজিক সংহতিকে সামনে রেখে আন্দোলনের ইতিবাচক প্রচার ও জনগণের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।
জনগণ ও সামাজিক আন্দোলনের শক্তি-
বর্তমানে বৃহত্তর নোয়াখালী জেলাবাসী সরকারের কাছে তাদের দাবী পৌঁছে দিতে সৃজনশীল ও জোরালো কর্মসূচি গ্রহণ করছে। নোয়াখালী জেলা সমিতি ঢাকা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সোচ্চার কন্ঠে আন্দোলন করছে। এটি পর্যায়ক্রমে বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের দিকে ধাবিত হচ্ছে, যা প্রমাণ করে জনগণ শুধু প্রতিক্ষারত নয়; তারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে।
অধিকন্তু, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মাধ্যমে অবহিত গণমত সৃষ্টি ও সরকারী চাপ প্রয়োগের কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এটি প্রমাণ করে, নোয়াখালীবাসীর আন্দোলন শুধু কাগজে বা ফেসবুক পোস্টে সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রাণবন্ত ও কার্যকরী।
সরকারের দায়িত্ব ও জনপ্রত্যাশা-
নোয়াখালী বিভাগের বিষয়টি দ্রুত ও কার্যকরীভাবে মোকাবিলা করা সরকারের দায়িত্ব। জনগণ ইতোমধ্যেই সোচ্চার। তারা শুধু দাবী জানাচ্ছে না, বরং সক্রিয় আন্দোলন এবং পরিকল্পিত কর্মসূচি গ্রহণ করছে। সরকারী উপদেষ্টা ও কর্মকর্তাদের এখন সময় এসেছে-নির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের, না হলে জনগণের প্রতিক্ষা অসন্তোষে পরিণত হতে পারে।
নোয়াখালীবাসী আশা করছে, তিনজন উপদেষ্টা-পরিকল্পনা, তথ্য ও সংস্কৃতি-দাবী বাস্তবায়নে সক্রিয় পদক্ষেপ নেবেন, এবং প্রশাসনিকভাবে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নোয়াখালী বিভাগের রূপ রচনা হবে। এটি কেবল প্রশাসনিক নয়, এটি রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
বিপ্লবী আহ্বান: নোয়াখালী বিভাগের দাবী কেবল স্থানীয় সুবিধার দাবী নয়; এটি জনগণের স্বীকৃতি, অধিকার ও সামাজিক উন্নয়নের দাবী। এটি বাংলাদেশে সুশাসন, সমতা ও স্থানীয় জনগণের অধিকার রক্ষার প্রতীক।
যে আন্দোলন এখন গড়ে উঠেছে-নোয়াখালী জেলা সমিতি এবং অন্যান্য সামাজিক সংগঠনগুলোর উদ্যোগে-তার শক্তি ব্যবহার করে সরকারের উচিত দাবীকে বাস্তব রূপ দেওয়ার পদক্ষেপ নেয়া। যদি সরকারের ভিতরের প্রভাবশালী উপদেষ্টা ও কর্মকর্তারা সময়মতো পদক্ষেপ না নেন, তবে জনগণের ধৈর্য অসন্তোষে ও প্রতিবাদে রূপ নেবে, যা প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
নোয়াখালীবাসী ইতোমধ্যেই সোচ্চার। তারা শুধু দাবী জানাচ্ছে না, তারা একটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের প্রত্যাশায় একত্রিত হয়েছে, এবং তাদের আহ্বান স্পষ্ট-এবার শুধু প্রতীক্ষা নয়,পদক্ষেপের সময় এসেছে।
নোঙরাত্মক অর্থে সরকারের পদক্ষেপের গুরুত্ব:
নোয়াখালী বিভাগের গঠন শুধু প্রশাসনিক নয়; এটি অঞ্চলের জনগণকে স্বীকৃতি দেয়ার, সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ নিশ্চিত করার এবং স্থানীয় শাসন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার হাতিয়ার। এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বাস্তব প্রয়োগ। যদি সরকার সময়মতো পদক্ষেপ না নেয়, তবে এটি জনমতের ক্ষয়, সামাজিক অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
অতএব, সময় এসেছে-উপদেষ্টা ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের একত্রে উদ্যোগ নিয়ে নোয়াখালী বিভাগের দাবী বাস্তবায়ন করতে হবে। নোয়াখালীবাসীর প্রত্যাশা স্পষ্ট-শুধু প্রতীক্ষা নয়, এখন পদক্ষেপের সময়।
নিঃসন্দেহে, নোয়াখালী বিভাগের দাবী শুধু প্রশাসনিক নয়, এটি সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার, জনগণের আশা ও স্বপ্নের প্রতীক। বৃহত্তর নোয়াখালী জেলাবাসী ইতোমধ্যেই সোচ্চার। নোয়াখালী জেলা সমিতি, ঢাকা, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে কার্যকর কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সরকারের উচিত এই সক্রিয় জনগণকে অবহেলা না করে তাদের দাবী বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া।
এবার সময় এসেছে-নোয়াখালীবাসী চায় পদক্ষেপ, না অপেক্ষা। নোয়াখালী বিভাগের গঠন কেবল প্রশাসনিক একটি প্রক্রিয়া নয়; এটি জনগণের অধিকার, সুশাসন এবং স্থানীয় স্বীকৃতির প্রতীক। সরকারের উচিত এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে নোয়াখালী বিভাগের স্বপ্ন বাস্তব হয়ে ওঠে এবং দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি শক্তিশালী হয়।
নোয়াখালীবাসীর প্রত্যাশা স্পষ্ট-এবার শুধু কথার নয়, কাজের সময়।
লেখক:মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক ও প্রকাশক
সাপ্তাহিক নবজাগরণ
অনলাইনে পড়তে:www.thenabajagaran.com
সবাই শেয়ার করুন