নবজাগরণ রিপোর্ট:১২ অক্টোবর ২০২৫
নোয়াখালী বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সূচিত হলো আজ নোয়াখালীতে।সকালে মাইজদীর নোয়ান্নই ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হলো দেশের প্রথম “টাইফয়েড ভ্যাকসিন ক্যাম্পেইন (TCV)-২০২৫” এর জেলা পর্যায়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নোয়াখালী জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ মরিয়ম সিমি, এবং প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক তাসলিমুন নেসা। বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন পুলিশ সুপার নোয়াখালী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, সদর, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, উচ্চ মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারবৃন্দ, আনসার ও বিডিপি প্রধান, ইমাম সমিতির প্রতিনিধি, উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ। মোট ২৪ জন কর্মকর্তা ও প্রতিনিধি উপস্থিত থাকলেও, তাদের ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠে উচ্চারিত হলো একটাই প্রতিশ্রুতি -“প্রত্যেক শিশু নিরাপদ, প্রত্যেক জীবন মূল্যবান।”
কেন এই কর্মসূচি ঐতিহাসিক?
টাইফয়েড এখনো বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্যের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। দূষিত পানি, অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার কারণে প্রতি বছর লাখ লাখ শিশু আক্রান্ত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্যমতে, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি মানুষ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে ৬০ শতাংশই শিশু-কিশোর।
এই বাস্তবতায় “টাইফয়েড কনজুগেট ভ্যাকসিন (TCV)” ক্যাম্পেইন হলো বাংলাদেশের এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ-যেখানে ৯ মাস থেকে ১৫ বছর বয়সী সব শিশু-কিশোরকে এক ডোজ টিকা দেওয়া হবে, যা তাদের দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা দেবে টাইফয়েড সংক্রমণের বিরুদ্ধে।
অনুষ্ঠানের মূল বার্তা:উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন-
“এই টিকা শুধু ইনজেকশন নয়, এটি আস্থার প্রতীক।
জনগণ ও প্রশাসনের মধ্যে যে স্বাস্থ্য-সেতু তৈরি হচ্ছে, সেটিই এই ক্যাম্পেইনের প্রকৃত সাফল্য।”
প্রথম পর্যায়ে জেলা সদরসহ প্রত্যেক উপজেলায় ভ্যাকসিনেশন কেন্দ্র স্থাপন করা হচ্ছে।স্কুল, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো হবে প্রধান ভ্যাকসিনেশন পয়েন্ট।তবে বক্তারা সতর্ক করেন-“কাগজে-কলমে উদ্বোধন নয়, মাঠপর্যায়ের সমন্বয়ই হবে প্রকৃত মাপকাঠি। টিকা যেন সত্যিকারের প্রতিটি শিশুর হাতে পৌঁছায়, সেটিই হবে প্রশাসনের সবচেয়ে বড় অর্জন।”
মাঠপর্যায়ের চ্যালেঞ্জ:সচেতনতার ঘাটতি: অনেক অভিভাবক এখনো জানেন না টিকা কোথায়, কবে, কার জন্য।লজিস্টিক সংকট: ঠান্ডা সংরক্ষণ (Cold Chain) ব্যবস্থাপনা দুর্বল এলাকায় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।
গ্রামীণ অংশগ্রহণ কম: শহরাঞ্চলে আগ্রহ থাকলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে তা কম। ভ্যাকসিনবিরোধী গুজব: কোভিডের সময়কার বিভ্রান্তি যেন আবার না ছড়ায়, সে বিষয়ে সতর্কতা দরকার।
ভবিষ্যতের করণীয়:প্রতিটি উপজেলায় জনসচেতনতা কমিটি গঠন করতে হবে।স্থানীয়ভাবে টিকা প্রদানের সময়সূচি প্রকাশ করতে হবে-পোস্টার, মসজিদের মাইক ও সামাজিক মাধ্যমে। AEFI (Adverse Event Following Immunization) মনিটরিং টিম সক্রিয় রাখতে হবে। স্থানীয় সাংবাদিকদের মাধ্যমে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ নিশ্চিত করতে হবে। জনস্বাস্থ্য নয়, এটি মানবিক আন্দোলনএই ক্যাম্পেইন কোনো প্রশাসনিক প্রোগ্রাম নয়; এটি মানবতার ডাক।একজন মা যখন নিশ্চিন্তে তার সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে পারেন, সেটিই রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপালনের আসল রূপ।নোয়াখালী জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য দপ্তর আজ যে যাত্রা শুরু করলো, সেটি কেবল একটি কর্মসূচির উদ্বোধন নয়-এটি এক নতুন জনস্বাস্থ্য বিপ্লবের সূচনা।
মাইজদীর অনুষ্ঠানটি হয়তো ছোট ছিল, উপস্থিতি ছিল সীমিত-কিন্তু এর অর্থ বিশাল:“প্রত্যেক শিশু নিরাপদ, প্রত্যেক জীবন অমূল্য।”নোয়াখালী আজ বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য ইতিহাসে রেখে গেল এক নতুন দৃষ্টান্ত-যেখান থেকে শুরু হলো “স্বাস্থ্য ন্যায়বিচারের” এক নব অধ্যায়।