নবজাগরণ বিশ্লেষণ:
এক হাজার বছরের ইতিহাসের গর্ভে এক অনন্য অঞ্চল -নোয়াখালী-বাংলাদেশের মানচিত্রে নোয়াখালী শুধু একটি জেলা নয়; এটি একটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ভূখণ্ডের নাম-যা মধ্যযুগ থেকেই বঙ্গের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মূল কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। প্রাচীন চন্দ্রবংশীয় রাজ্য, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আরম্ভ হয়ে মেঘনা-পদ্মা-ফেনী নদীর মধ্যবর্তী ভূমি-এ অঞ্চলেই সৃষ্টি হয়েছিল এক স্বতন্ত্র উপভাষা, স্বতন্ত্র লোকসংস্কৃতি, এবং প্রখর আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন জনগোষ্ঠী।
‘নোয়াখালী’ শব্দের আদি রূপ ‘নওয়াখাল’-অর্থাৎ ‘নতুন খাল’। ১৭৫৬ সালে মেঘনার ভাঙনে যখন রাজধানী টমছমবাজার নদীগর্ভে বিলীন হয়, তখন প্রশাসন স্থানান্তরিত হয় সোনাইমুড়ি ও বেগমগঞ্জ অঞ্চলে। সেই সময় থেকেই নোয়াখালী হয়ে ওঠে বঙ্গের পূর্ব-দক্ষিণাঞ্চলের সাংস্কৃতিক মেরুদণ্ড।
প্রশাসনিক ছিন্নভিন্নতা: এক ইতিহাসের নীরব ক্ষত
ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশ পর্যন্ত নোয়াখালী প্রশাসনিকভাবে বারবার বিভক্ত হয়েছে-প্রতিবারই রাজনৈতিক প্রভাব, ক্ষমতাকেন্দ্রের স্বার্থ আর অদৃশ্য প্রশাসনিক পরিকল্পনার ছুরি নেমেছে এই অঞ্চলের শরীরে।
একসময় নোয়াখালীর প্রশাসনিক পরিধিতে ছিল-
বর্তমান ফেনী জেলা লক্ষ্মীপুর জেলা কুমিল্লার দক্ষিণাঞ্চলের বিশাল অংশ (লাকসাম, মনোহরগঞ্জ, নাঙ্গলকোট, বাগমারা, লালমাই ও চৌদ্দগ্রাম পর্যন্ত)
এমনকি দক্ষিণে চরফ্যাশন ও তজিমউদ্দিন পর্যন্ত বিস্তৃত দ্বীপমালা পূর্বদিকে মিরসরাই ও স্বন্দ্বীপও নোয়াখালীর বাণিজ্য-সংস্কৃতির ধারাবাহিক অংশ ছিল।
এই ভূখণ্ড ছিল এক প্রাণবন্ত নদীমাতৃক সভ্যতা-যেখানে ফেনী নদী ছিল না বিভাজনরেখা, বরং সংযোগরেখা।
কিন্তু সময়ের রাজনৈতিক ভাগাভাগি, প্রশাসনিক ছলচাতুরি, ও কিছু শক্তিশালী ব্যক্তিস্বার্থের কারণে
নোয়াখালীকে ধীরে ধীরে কেটে কেটে ছোট করা হয়েছে-
যেন একটি সমৃদ্ধ জাতিসত্তাকে ‘অতিরিক্ত শক্তিশালী’ হতে না দেওয়া হয়।
ন্যায়বিচারের প্রশ্ন: কে নিল, কেন নিল, কে ফেরাবে?
নোয়াখালী থেকে লাকসাম, মনোহরগঞ্জ, নাঙ্গলকোট, বাগমারা, লালমাই ও চৌদ্দগ্রামকে কুমিল্লার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এমন এক সময়ে,যখন নোয়াখালীর সঙ্গে ঐসব অঞ্চলের ভাষা, অর্থনীতি, শিক্ষা, পরিবারিক সম্পর্ক-সবই ছিল অভিন্ন।আজও মনোহরগঞ্জ থেকে বেগমগঞ্জের বাজারে মানুষ যায়, বিয়েশাদি হয় একে অপরের সঙ্গে, ভাষার উচ্চারণে কোন পার্থক্য নেই-তবুও রাজনৈতিক প্রশাসনের মানচিত্রে এক বিভাজনরেখা টেনে দেওয়া হয়েছে, যা ইতিহাস ও বাস্তবতাকে অপমান করেছে।
একইভাবে দক্ষিণে ভোলার চরফ্যাশন ও আজিমউদ্দিন অঞ্চল,এবং পূর্বের মিরসরাই-স্বন্দ্বীপও একসময় নোয়াখালীর ধর্মীয় ও বাণিজ্যকেন্দ্রিক পরিধির অংশ ছিল।
আজও স্বন্দ্বীপের মানুষ বলে-“আমরা নোয়াখালীরই লোক”-কারণ, সংস্কৃতির শিকড় কখনও মানচিত্রের রেখা মানে না। তাহলে প্রশ্ন আসে-এই প্রশাসনিক ছেদন কি শুধু মানচিত্রের ভুল, নাকি এক পরিকল্পিত রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি?
ভারত-পাকিস্তান বিভক্তি, ১৯৭১ ও নোয়াখালীর ভূরাজনীতি-১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় নোয়াখালীর ভৌগোলিক অবস্থান পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম কৌশলগত ফ্রন্টলাইন হয়ে ওঠে।মেঘনা-ফেনী নদীমালা ঘিরে এখানে গড়ে ওঠে যোগাযোগ, নদীবন্দর ও আঞ্চলিক অর্থনীতির কেন্দ্র। কিন্তু ১৯৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামের পর স্বাধীন বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় প্রশাসন সব শক্তি ঢেলে দেয় ঢাকা-কেন্দ্রিক শাসনে।ফলত: চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা প্রশাসনিকভাবে অগ্রাধিকার পায়, কিন্তু নোয়াখালী-যে ঐতিহাসিকভাবে সাংস্কৃতিক রাজধানী ছিল-তা থেকে বঞ্চিত হয় অবকাঠামো, শিক্ষা ও শিল্পোন্নয়ন থেকে।
স্বাধীনতার পরে ১৯৮৪ সালে কুমিল্লা ও নোয়াখালী ভেঙে ফেনী ও লক্ষ্মীপুর জেলা গঠন করা হয়-কিন্তু প্রশাসনিক অঞ্চল গঠনের এই প্রক্রিয়ায় “অঞ্চলভিত্তিক ঐতিহাসিক সংহতি”র বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি;এ যেন নিজের শরীর থেকে হাত কেটে ফেলার মতো।
নোয়াখালী বিভাগ: শুধু প্রশাসনিক নয়, এটা আত্মপরিচয়ের পুনঃস্থাপন আজ যখন সারাদেশে প্রশাসনিক পুনর্গঠনের আলোচনা চলছে,তখন নোয়াখালী বিভাগ কেবল একটি “অতিরিক্ত দপ্তর” নয়-এটা এক সাংস্কৃতিক পুনর্জন্ম।
নোয়াখালী বিভাগের আওতায় আসা উচিত-
নোয়াখালী জেল ফেনী জেলা লক্ষ্মীপুর জেলা
চাঁদপুরের দক্ষিণাংশ (মতলব দক্ষিণ, হাজীগঞ্জ পর্যন্ত)
কুমিল্লার দক্ষিণাঞ্চল-লাকসাম, মনোহরগঞ্জ, নাঙ্গলকোট, বাগমারা, লালমাই, চৌদ্দগ্রাম ভোলার চরফ্যাশন-তজিমউদ্দিন স্বন্দ্বীপ ও মিরসরাইয়ের ঐতিহাসিক সংযুক্ত হাতিয়াকে জেলা করে অঞ্চলসমূহ এই গঠন শুধুমাত্র ন্যায্যতাবোধের প্রতিফলন নয়, এটি প্রশাসনিক কার্যকারিতা, অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ এবং আঞ্চলিক ভারসাম্যের চাবিকাঠি।
অর্থনৈতিক যুক্তি: নোয়াখালী বিভাগের প্রয়োজন এখনই
উপকূলীয় অর্থনীতি:মেঘনা নদী ও বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা নোয়াখালী-ভোলা-স্বন্দ্বীপ অঞ্চল বাংলাদেশের উপকূলীয় অর্থনীতির ৩৫% জিডিপি-সম্ভাবনাকে ধারণ করে।এই অঞ্চলে পৃথক বিভাগ হলে সহজে বন্দর, মেরিন বিশ্ববিদ্যালয়, মৎস্য-শিল্প, ও সমুদ্রসম্পদ উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
শিক্ষা ও গবেষণার বিস্তার:নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (NSTU), বেগমগঞ্জ টেক্সটাইল ইন্সটিটিউট, ফেনী মেডিক্যাল কলেজ-সবই এখন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পরিচালিত হচ্ছে।বিভাগ হলে “নোয়াখালী রিজিওনাল এডুকেশন বোর্ড” গঠন করে সমন্বিত উচ্চশিক্ষা নীতি প্রণয়ন করা সম্ভব।
শিল্পায়ন ও শ্রমশক্তি:ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মাঝখানে অবস্থিত হওয়ায় নোয়াখালী অঞ্চলটি শিল্পপ্রসারের ‘গোল্ডেন বেল্ট’। কিন্তু বিভাগ না থাকায় প্রশাসনিক অনুমোদন, শিল্পপল্লী, ও বিনিয়োগে ধীরগতি।
একটি স্বতন্ত্র বিভাগ এই অঞ্চলের শিল্পশক্তিকে দ্বিগুণ গতিতে এগিয়ে নিতে পারবে।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক একতা: যা প্রশাসন ভাঙতে পারেনি
নোয়াখালীর মানুষ এক অদ্ভুত ঐক্যে বাঁধা।
তুমি ভোলার চর থেকে শুরু করে স্বন্দ্বীপ বা মনোহরগঞ্জ পর্যন্ত ঘুরে দেখো-তাদের ভাষার ঢং, হাসির ছন্দ, কণ্ঠের টান, কৌতুকবোধ, অতিথিপরায়ণতা-সব একই রকম।তারা নিজেদের ‘নোয়াখালীয়া’ বলেই চেনে।এই জনগোষ্ঠীকে প্রশাসনিকভাবে বিভক্ত রেখে কেন্দ্র যদি উন্নয়নকে “সুবিধা” বলে চালিয়ে দেয়;তাহলে সেটা কেবল রাজনৈতিক ভণ্ডামি।
নোয়াখালী বিভাগের পক্ষে পাঁচটি প্রমাণযোগ্য যুক্তি
ঐতিহাসিক ঐক্য:প্রাক-ব্রিটিশ আমল থেকে ফেনী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর ও কুমিল্লার দক্ষিণাঞ্চল নোয়াখালী প্রশাসনের অধীন ছিল। ১৯৮০-এর পর রাজনৈতিক কারণে কাটা হয়-প্রশাসনিক কারণে নয়।
ভাষা ও সংস্কৃতি:নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষা ‘বেগমগঞ্জ-মনোহরগঞ্জ-লাকসাম’ উপভাষা একেবারে অভিন্ন।বাংলা একাডেমির আঞ্চলিক ভাষা সমীক্ষায় এটি প্রমাণিত (রেফ: বাংলা একাডেমি লোকভাষা জরিপ, ২০১Nabojagoৈতিক প্রবাহ:চৌমুহনী, মাইজদী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুর-এই চারটি বাজার অঞ্চল দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলীয় অর্থনীতির মূল বাণিজ্যিক করিডোর।কুমিল্লার শিল্পায়ন এই করিডোরের সঙ্গে সম্পৃক্ত, বিচ্ছিন্ন নয়।
প্রশাসনিক ভারসাম্য:ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত জনসংখ্যা, প্রশাসনিক চাপ ও দুর্নীতি কমাতে নোয়াখালী বিভাগ একটি প্রয়োজনীয় বিকেন্দ্রীকরণ।
জাতীয় নিরাপত্তা ও সীমান্তব্যবস্থাপনা:বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল হলো সামুদ্রিক সীমান্তের প্রথম প্রতিরক্ষা রেখা।এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও দ্রুত প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিরাপত্তার প্রশ্নেও অপরিহার্য।
জুলাই বিপ্লব ও নতুন গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি: “অংশীদারিত্বের বিভাগ”জুলাই ২০২৫-এর বিপ্লবের পর জনগণ নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে-যেখানে রাজনীতি শুধু ঢাকা-নির্ভর নয়,বরং প্রতিটি অঞ্চল নিজেদের ভাগ্যনির্ধারণে অংশ নিতে পারে।
নোয়াখালী বিভাগ সেই নতুন বাংলাদেশের প্রথম পরীক্ষাক্ষেত্র হতে পারে।কারণ এখানে আন্দোলন আছে, ঐক্য আছে, ইতিহাস আছে, এবং আছে সংস্কৃতির শক্তি।যদি সরকার সত্যিই অংশীদারিত্বের গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে,তাহলে জনগণের এই দাবি উপেক্ষা করা মানে ইতিহাসকে অস্বীকার করা।
বিপ্লবের ডাক: “পূর্বের নোয়াখালী ফিরিয়ে দাও-লাকসাম, মনোহরগঞ্জ, নাঙ্গলকোট, বাগমারা, লালমাই, চৌদ্দগ্রাম ফিরিয়ে দাও-ভোলা, চরফ্যাশন, স্বন্দ্বীপ, মিরসরাই ফিরিয়ে দাও-আমাদের বিভাগ দাও, আমাদের ইতিহাস ফিরিয়ে দাও!”এটাই আজকের জনতার আওয়াজ।এটি কেবল আঞ্চলিক দাবি নয়, এটি ঐতিহাসিক পুনর্বিন্যাসের আন্দোলন।নোয়াখালী বিভাগের প্রশ্ন এখন জাতীয় পুনর্গঠনের প্রশ্ন।
নোয়াখালী বিভাগ কোনো রাজনৈতিক স্লোগান নয়-এটি একটি ঐতিহাসিক সংশোধন, ন্যায়বিচারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং জনগণের সম্মানের প্রতীক।যতদিন পর্যন্ত প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক মানচিত্রে নোয়াখালীর প্রকৃত ভূখণ্ড ফিরিয়ে আনা না হবে,ততদিন এই আন্দোলন থামবে না।
আজ নোয়াখালীর মানুষ নতুন ভাষায় বলছে- “আমরা ভাঙা জেলা চাই না, আমরা পূর্ণ নোয়াখালী বিভাগ চাই।”
কারণ এই বিভাগ গঠিত হলে,
বাংলাদেশ পাবে এক নতুন সীমানা,
আর জনগণ পাবে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা।
লেখক:মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক, নবজাগরণ
অনলাইনে পড়ুন:www.thenabajagaran.com