-মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
সংসদ ভবনের সামনে নোয়াখালীবাসীর আকস্মিক জেগে ওঠা এক নতুন ঐতিহাসিক মুহূর্ত
সংসদ ভবনের সামনে হঠাৎ জড়ো হয় হাজারো মানুষের ঢল। ব্যানার উড়ছে-“নোয়াখালী বিভাগ চাই, হাতিয়া জেলা চাই”। একদল তরুণ-তরুণী হাতে জাতীয় পতাকা, আরেকদল বয়োবৃদ্ধ কৃষক-শ্রমিক চোখে অশ্রু। কেউ স্লোগান দিচ্ছে-“বেগমগঞ্জ চৌরাস্তা থেকে সংসদ পর্যন্ত এক দাবিই এক আওয়াজ-নোয়াখালী বিভাগ চাই!” সেনা-পুলিশ তৎপর, নিরাপত্তা জোরদার, তবু জনতার কণ্ঠে কোনো ভয় নেই।এই আন্দোলন কোনো হঠাৎ জোয়ার নয়। এটি এক দীর্ঘকালীন বঞ্চনা, অবহেলা, প্রশাসনিক বৈষম্য, এবং উন্নয়ন-বঞ্চিত জনপদের মানুষের আত্মচেতনার বিস্ফোরণ।
আন্দোলনের ভূমিকায়: নীরব নোয়াখালী আজ গর্জে উঠেছে-বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগের রয়েছে প্রশাসনিক সুবিধা, উন্নয়ন পরিকল্পনা, বাজেট কাঠামো। অথচ নোয়াখালী-যে জনপদ ইতিহাসে আলোর দিশারি ছিল, যে অঞ্চল স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, শিক্ষাবিপ্লব-সব জায়গায় অবদান রেখেছে-সেই নোয়াখালী আজও “বিভাগহীন”!
প্রশাসনের কেন্দ্রীকরণ, ঢাকা-কেন্দ্রিক রাজনীতির অযৌক্তিক দখলদারিত্ব, এবং প্রান্তিক জেলা-উপজেলাগুলোর প্রতি অবহেলার ফলেই আজ এই আন্দোলন জ্বলে উঠেছে।নোয়াখালীর মানুষ আজ আর কান্নার ভাষায় কথা বলে না; তারা যুক্তির ভাষায়, আদর্শের ভাষায় বলছে- “আমরা কারো বিরুদ্ধে না, আমরা ন্যায়বিচারের পক্ষে। নোয়াখালী বিভাগ চাই-এ আমাদের জন্মগত অধিকার।যৌক্তিকতা ও প্রশাসনিক প্রয়োজন
একটি বিভাগ গঠনের মূলনীতি হলো-ভূগোল, জনসংখ্যা, অর্থনীতি ও প্রশাসনিক দক্ষতার ভারসাম্য।
নোয়াখালীর এই চার ক্ষেত্রেই পূর্ণ সামর্থ্য বিদ্যমান:
জনসংখ্যা: বৃহত্তর নোয়াখালী অঞ্চলের (নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, হাতিয়া, সুবর্ণচর, সেনবাগ, সোনাইমুড়ী, চাটখিল) সম্মিলিত জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ-যা বরিশাল বা সিলেট বিভাগের চেয়েও বেশি।
অর্থনীতি: রেমিট্যান্স, কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্প-এই তিন স্তম্ভে নোয়াখালী আজ দেশের অন্যতম শক্তিশালী জনপদ।
ভূগোল ও বন্দর: সোনাপুর, হাতিয়া ও সুবর্ণচরের সমুদ্রঘেঁষা বন্দর এবং নদীপথে সহজ যোগাযোগের সুযোগ প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে নোয়াখালীকে স্বাভাবিকভাবে যোগ্য করে তুলেছে।
শিক্ষা ও মানবসম্পদ: নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, মেরিন একাডেমি, টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট-এই প্রতিষ্ঠানগুলো প্রমাণ করছে, দক্ষ জনবল তৈরিতে নোয়াখালী পিছিয়ে নেই।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে-কেন এখনো নোয়াখালী বিভাগ হয়নি?
এর উত্তর একটাই-রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং প্রশাসনিক কেন্দ্রিকতার দুঃশাসন।
আন্দোলন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে
নোয়াখালী বিভাগের দাবির ঢেউ এখন শুধু বেগমগঞ্জ বা সেনবাগে সীমাবদ্ধ নয়।এটি ছড়িয়ে পড়ছে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য,আফ্রিকা, উত্তর আমেরিকায় থাকা প্রবাসীদের মাঝে।প্রবাসী নোয়াখালীবাসী এখন সামাজিক মাধ্যমে, রাস্তায় রাস্তায়, বিভিন্ন দূতাবাসের সামনেও বলছে- “আমাদের মাতৃভূমি অবহেলিত, কিন্তু আমাদের গর্ব অপরিসীম।”প্রবাসীরা অর্থ পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রেখেছে; এখন তারা চায় প্রশাসনিক সম্মান-একটি নোয়াখালী বিভাগ।
আন্দোলনের চরিত্র: বিনয়,শৃঙ্খলা ও নৈতিকতার আন্দোলন-এই আন্দোলন বাংলাদেশের অন্য যেকোনো আন্দোলন থেকে আলাদা।এখানে নেই লাঠি, গুলি, হানাহানি। নেই অশালীন ভাষা বা হুমকি।নোয়াখালীর মানুষ জানে-“বিনয়ই শক্তি, শৃঙ্খলাই বিপ্লব।”বিভাগ আন্দোলনের কর্মীরা প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে মসজিদের ইমাম, স্কুলশিক্ষক, ব্যবসায়ী, কৃষক, সাংবাদিক, আইনজীবী-সবার কাছে ব্যাখ্যা করছে দাবির যৌক্তিকতা।
তারা বলছে-“আমরা রক্ত চাই না,আমরা ন্যায় চাই।
আমরা ক্ষমতা চাই না, আমরা প্রশাসনিক স্বীকৃতি চাই।”
ইতিহাস ভুলে গেলে জাতি অন্ধ হয়ে যায়
বাংলাদেশের ইতিহাসে নোয়াখালী মানেই জাতির নবজাগরণ।এই ভূমিতে জন্ম নিয়েছে একসময়ের দানবীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ আন্দোলন, সমাজ সংস্কারক, ইসলাম প্রচারক, ও বিপ্লবী জননেতারা।
নোয়াখালী শান্তি মিশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী নিজে-যেখানে তিনি বলেছিলেন, “নোয়াখালী আমার তীর্থভূমি, এখানকার মানুষ আমার প্রার্থনা।”তবু রাষ্ট্র আজ সেই নোয়াখালীকে প্রান্তিকতার অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে।
যে নোয়াখালী একদিন দেশকে আলো দেখিয়েছে, আজ সেই নোয়াখালী নিজেই আলোর জন্য আন্দোলন করছে-এটাই আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।
সংসদ ভবনের সামনে জনতার ঢল: নতুন অধ্যায়
আজ সংসদ ভবনের সামনে হাজারো মানুষের গর্জন যেন ঘোষণা করছে- “আমরা রাষ্ট্রের সন্তান, প্রজা নই।”
সেনা-পুলিশের কঠোর অবস্থান, টিয়ারশেল প্রস্তুত-কিন্তু আন্দোলনকারীদের হাতে শুধু পতাকা, আর মুখে ন্যায়বিচারের স্লোগান।একজন বৃদ্ধ কৃষক বলছিলেন, “আমরা নোয়াখালীর মানুষ, আমরা কাউকে ভয় পাই না। কিন্তু আমরা কারো বিরুদ্ধে না। আমরা শুধু আমাদের প্রাপ্য বিভাগ চাই।”এই আন্দোলন এখন কেবল প্রশাসনিক দাবি নয়; এটি একটি মর্যাদার সংগ্রাম, অস্তিত্বের লড়াই, এবং বাংলাদেশের বিকেন্দ্রীকরণের আন্দোলন।
রাষ্ট্রকে পুনর্বিবেচনার আহ্বান রাষ্ট্র যদি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক হয়, তবে তাকে শুনতে হবে প্রান্তিক মানুষের কথা।একটি প্রশাসনিক কেন্দ্রের ভারসাম্যহীনতা যখন গোটা অঞ্চলের উন্নয়ন আটকে দেয়, তখন বিভাগ সৃষ্টি কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়-এটি নৈতিক দায়বদ্ধতা।
প্রধান উপদেষ্টা, সেনাপ্রধান, প্রশাসনিক উপদেষ্টারা-সবাই জানেন, বৃহত্তর নোয়াখালীর জনগণ শৃঙ্খলাবদ্ধ, শ্রমনিষ্ঠ, এবং রাষ্ট্রভক্ত।তারা বিদ্রোহ চায় না, তারা মর্যাদা চায়।
আজ যদি এই দাবিকে উপেক্ষা করা হয়, তবে রাষ্ট্র ভবিষ্যতে বড় এক সামাজিক বিস্ফোরণের মুখে পড়বে।
মানুষের কণ্ঠস্বর: শহর থেকে প্রবাস পর্যন্ত
বেগমগঞ্জ চৌরাস্তা, চাটখিল, সোনাইমুড়ী, হাতিয়া, সুবর্ণচর, ফেনী-সব জায়গায় মাইকে, চায়ের দোকানে, মসজিদের বারান্দায়, ক্লাসরুমে, এমনকি বিদেশের নির্মাণ সাইটে একটিই আলোচনা- “কবে হবে নোয়াখালী বিভাগ?”
প্রবাসী শ্রমিক মো. রফিক বলছেন, “আমরা রেমিট্যান্স পাঠাই, দেশের জন্য পরিশ্রম করি, এখন চাই সম্মান-আমাদের মাতৃভূমি যেন বিভাগ হয়।”
এটাই আসলে বাংলাদেশের মানুষের অভ্যন্তরীণ শক্তি-ভালোবাসার আন্দোলন।
সরকারের নীরবতা: জনমনে গভীর প্রশ্
কেন সরকার এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি?কেন একটি ন্যায্য দাবির আন্দোলনে কোনো প্রতিনিধিকে পাঠানো হয়নি?জনমনে প্রশ্ন জেগেছে-রাষ্ট্র কি আবারও প্রান্তিকের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করছে?এই নীরবতা আজ একধরনের “অঘোষিত প্রত্যাখ্যান”-যা জনতাকে আরও ক্ষুব্ধ করছে।
কেন নোয়াখালী বিভাগ হবে সবচেয়ে সফল?
প্রাকৃতিক সম্পদ ও সমুদ্রবন্দর
রেমিট্যান্সে শীর্ষ জেলা
কৃষি ও শিক্ষায় অগ্রগামী
প্রবাসী জনশক্তিতে নেতৃত্বদানকারী অঞ্চল
ঐতিহাসিকভাবে শান্ত, শৃঙ্খলাপূর্ণ জনসংগঠন
এই পাঁচ ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে বলা যায়-নোয়াখালী বিভাগ হবে বাংলাদেশের সবচেয়ে দ্রুতবর্ধনশীল প্রশাসনিক অঞ্চল।
চূড়ান্ত বার্তা: দমিয়ে রাখা যাবে না
আজকের আন্দোলন কোনো রাজনীতিবিদের সৃষ্টি নয়; এটি জনগণের নিজস্ব চেতনা।এ চেতনা দমন করার শক্তি কোনো রাষ্ট্রযন্ত্রের নেই।যেমন জুলাই সনদ ঘোষণা করেছিল দেশের নৈতিক জাগরণ,তেমনই “নোয়াখালী বিভাগ আন্দোলন” আজ নতুন প্রশাসনিক মুক্তির প্রতীক হয়ে উঠছে।রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে- “যেখানে নোয়াখালী জেগে ওঠে, সেখানে বাংলাদেশ নবজাগরণে প্রবেশ করে।”
নোয়াখালী বিভাগ চাই-এ শুধু একটি স্লোগান নয়, এটি বাংলাদেশের বিকেন্দ্রীকরণের মন্ত্র, প্রান্তিকের পুনর্জাগরণের ডাক।এই আন্দোলন ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে সেই মুহূর্ত হিসেবে-যখন জনগণ নীরবতা ভেঙে দাঁড়িয়ে বলেছিল:“আমরা ন্যায় চাই, আমরা নোয়াখালী বিভাগ চাই।”
লেখক: মো: আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক, নবজাগরণ
🌐 অনলাইনে পড়ুন: www.thenabajagaran.com
#NoakhaliDivision #Noakhali #Begumgonj #Hatia #Feni #Lakshmipur #Bangladesh #Nabajagaran #BreakingNews #Protest #Parliament #NoakhaliJonota #DemandJustice #TodayNews #Revolution #UnitedNoakhali #VoiceOfNoakhali