মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
বিশ্বের মানচিত্র কখনোই নীরব থাকে না। ইতিহাস বারবার ফিরে আসে-নতুন রঙে, নতুন ভাষায়, নতুন পরিকল্পনায়। তুরস্ক আজ এমন এক পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে অতীতের Ottoman Empire-র স্মৃতি, বেদনা, মহিমা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা আবারও রাজনৈতিক বাস্তবতায় ফিরে দেখা দিচ্ছে। প্রশ্নটি তাই এখন শুধু একাডেমিক নয়-এটি ভূরাজনৈতিক, কৌশলগত এবং সভ্যতাগত প্রশ্ন:
তুরস্ক কি আবার অটোমান সাম্রাজ্যের রূপে এগিয়ে যাচ্ছে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই সময়-যখন ইউরোপীয় উপনিবেশবাদী শক্তিগুলো মুসলিম বিশ্বকে ভেঙে ছিন্নভিন্ন করেছিল; যখন সাম্রাজ্যগুলো ভেঙে বর্ণরেখা টেনে টেনে নতুন দেশ সৃষ্টি করা হয়েছিল; যখন যুদ্ধের টেবিলে কাগজ-কলম দিয়ে ভাগ করা হয়েছিল মানচিত্র, মানুষ, ভাষা, ভবিষ্যৎ।
প্রথম অধ্যায়: পতনের ছায়া-কারা ভাঙলো অটোমান সাম্রাজ্যকে?অটোমান সাম্রাজ্য ছিল পৃথিবীর দীর্ঘতম মুসলিম সাম্রাজ্যগুলোর একটি-৬০০ বছর ধরে তিন মহাদেশে (এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ) শাসন করেছে। কিন্তু ১৯শ শতকে ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলোর-বিশেষ করে United Kingdom, France ও Russia-সমন্বিত ষড়যন্ত্র ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ঘেরাওয়ের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্য দুর্বল হতে থাকে।এই দুর্বলতা ক্যাপ করে রাখতে সহায়ক ছিল ভেতরকার দুর্নীতি, আধুনিকীকরণে ব্যর্থতা, সাংস্কৃতিক
ও ভাষাগত বিভাজন, এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়ঙ্কর
প্রভাব।অতিরিক্তভাবে, জাতিগত ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ (যেমন আরব জাতীয়তাবাদ, বালকান রূপান্তর) কেন্দ্রীয় শাসনকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। এই সন্নিহিত কারণগুলো মিলিয়ে সাম্রাজ্যের বিধ্বস্ততা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সবচেয়ে বড় আঘাত ছিল-মানচিত্র পুনর্বিন্যাস।একদিকে সাম্রাজ্যের ভেতর থেকে বিলুপ্ত হচ্ছিল শাসনক্ষমতা, অন্যদিকে বহিরাগত শক্তিগুলো নতুন নিয়মেই বিভাজন ঘটাচ্ছিল। এই বিশৃঙ্খলার মাঝেই লুজান-পরবর্তী যুগের রূপরেখা নির্ধারিত হয়।
দ্বিতীয় অধ্যায়: সুইজারল্যান্ডে লুজান-যেখানে ইতিহাসকে পুনরায় লেখা হলো-১৯২৩ সালের Treaty of Lausanne (লুজান) ছিল সেই মুহূর্ত, যখন অটোমান সাম্রাজ্যের অধিকাংশ ভূখণ্ড ছিন্ন হয়, নতুন জাতি-রাষ্ট্রের জন্ম হয় এবং পুরনো নিয়মানুগ ব্যবস্থার অবসান ঘটে।এই চুক্তিতে আলোচনায় ছিল-তুরস্কের ভূমিসীমানা, শরণার্থী ও সংখ্যালঘু অধিকার, সামরিক সীমাবদ্ধতা ও অর্থনৈতিক আরোপ। চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ২৪ জুলাই ১৯২৩-এ, যা ছিল ভিত্তি আধুনিক তুরস্ক রাষ্ট্রের।তবে এই চুক্তি ছিল
একান্তভাবে শান্তির চুক্তি নয়-বলেই যুক্তি প্রদর্শন করে, এটি ছিল শক্তি-ভিত্তিক রাজনৈতিক সমন্বয়।সহজভাবে: পরাজিত পক্ষের নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে বিজয়ী পক্ষের স্বার্থ ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করাই মূল লক্ষ্য ছিল।এই প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-চুক্তি প্রয়োগে যারা প্রতিনিধিত্ব করেছিল, তাদের ভূমিকার বিশ্লেষণ আমাদের জন্য দরকার। কারণ ইতিহাসের মোড়গুলি কখনোই কেবল ‘বাহিরের চাপ’ দ্বারা গড়ে ওঠে না; ভেতরের সংযোগ, যোগসাজশ ও স্থানীয় শক্তি-সন্ধান অনিবার্য ভূমিকাভাগী।
তৃতীয় অধ্যায়:আজকের তুরস্ক-নিয়তি ডাকছে
আজকের তুরস্ক (Turkey) ভিন্ন এক মোড়ে দাঁড়িয়ে। দেশটি ইতোমধ্যে-নিজস্ব ড্রোন ও সামরিক প্রযুক্তিতে দ্রুত অগ্রগতি করেছেমধ্যপ্রাচ্য, বাক্যানে ও আফ্রিকার অংশে কূটনৈতিক ও সামরিক হস্তক্ষেপ বাড়িয়েছে বালকান ও মধ্য এশিয়ার মুসলিম-সংস্কৃতি অঞ্চলে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে অতীত অটোমান ঐতিহ্য, ভাষা ও ইতিহাসকে রাষ্ট্রীয় ন্যারেটিভে পুনরুজ্জীবিত করেছে এই তরঙ্গকে বলা হয়-নিউ-অটোমানিজম” (Neo-Ottomanism)
এটি পুরনো সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা নয়-তবে এক শক্তিশালী দেশ নিজস্যতা, ইতিহাসের প্রতিকৃতি ও ভূরাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বিশ্বায়িত ভূবিনি তৈরি করছে।তুরস্ক অতীতের মানচিত্র ফিরিয়ে আনতে চাইছে না; তারা চাইছে ভূমধ্যসাগরীয়, ককাস, মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বে একটি প্রভাবশালী অবস্থান পুনরুদ্ধার করতে।
চতুর্থ অধ্যায়: গুরুত্বপূর্ণ দুই ব্যক্তি-লর্ড কার্জন ও হাইম নাহুম (Effendi)লর্ড জর্জ নাথানিয়েল কার্জন (Lord George Nathaniel Curzon, Marquess of Kedleston)
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী নীতিবিদ ও আরিস্টোক্র্যাট, যিনি ১৯১৯-২৪ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। লুজান সম্মেলনের প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ স্বার্থকে সর্বোচ্চ রূপে অর্জনের জন্য তিনি দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তার দৃঢ় মনোবল, আপাতই নিশ্চিত স্বার্থ অনুসরণ, এবং শক্তিধর কূটনীতিকে সক্রিয় করা-সব মিলিয়ে তাকে ইতিহাসে একটি জটিল ব্যক্তিত্ব করেছে।
Chaim Nahum Effendi(হাইম নাহুম,১৮৭২-১৯৬০)
তিনি ছিলেন তুর্কি ইহুদি সমাজের উচ্চপদস্থ ধর্মীয় নেতা ও কূটনীতিক। ১৮৭২ সালে মনিসা (তুরস্ক)-তে জন্ম, প্যারিস ও ইস্তাম্বুলে অধ্যয়ন করেছেন, ১৯০৯ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের হাকাম বাসি (Hakham Bashi) বা চীফ রাব্বি মনোনীত হন। ১৯২২-২৩ সালে লুজান সম্মেলনের সময় তুর্কি প্রতিনিধিদলে সম্মানিত উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি পরবর্তীতে মিশরের চীফ রাব্বি ও সেনেটর হন। তার এই উপস্থিতি দেখায়-কেবল ধর্মীয় নেতা নয়, একাধারে কূটনীতিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিত্বও ছিলেন তিনি।সংশ্লিষ্ট গবেষকরা দেখছেন: তার ব্যক্তিগত পরিচিতি ও ধর্মীয় বেস থাকা সত্ত্বেও, রাজনীতিতে তার ভূমিকা ছিল বহুমাত্রিক-কখনও একপক্ষের‘সদস্য’কখনও অন্যপক্ষের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে। এই সংকট ও বিরোধাত্মক অবস্থা তাকে ইতিহাসে রহস্যময় অবস্থানে বসিয়েছে।
পঞ্চম অধ্যায়:“ষড়যন্ত্র” বনাম“স্বার্থ-ভিত্তিক কৌশল”
আজও অনেকেই দাবি করেন-লুজান চুক্তি ও অটোমান সাম্রাজ্যের ধ্বসনের পেছনে ছিল গোপন ষড়যন্ত্র। কিন্তু যুক্তি বলছে:প্রতিনিধিদল ও কূটনীতিকদের নির্ভরযোগ্য তথ্য ও পরিসংখ্যান বিবেচনায় নিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় স্বার্থ-ভিত্তিক রণনীতিই প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল।
লর্ড কার্জন যুক্ত ছিলেন ব্রিটিশ স্বার্থ রক্ষায়; হাইম নাহুম ছিলেন তুর্কি/ইহুদি ধর্ম-সংঘের নেতা ও প্রতিনিধিত্বকারী-তাদের ব্যক্তিগত ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে “একক ষড়যন্ত্রকারক” বানানো ইতিহাসবিদ্যায় যায় না।
চুক্তি-নামার সিদ্ধান্ত নির্ভর করেছে জোটবদ্ধ শক্তি-সামর্থ্য, যুদ্ধের ফলাফল ও নতুন বিশ্বব্যবস্থার ওপর-এটিই মূল চালিকা।তাই, “ইহুদি” বা “ব্রিটিশ” অথবা “তুর্কি” পরিচয়ের ভিত্তিতে কাউকে স্বয়ং ষড়যন্ত্রের দুষ্কৃতিকারক বানিয়ে দেওয়া একটি বিপত্তিকর দৃষ্টিভঙ্গা।
ষষ্ঠ অধ্যায়: বাংলাদেশ-পরিপ্রেক্ষিত-আমাদের জন্য কী শিক্ষা?বাংলাদেশের জন্য এই বিশ্লেষণ শুধু ইতিহাসমূলক না-বরং সতর্কতা ও সংবেদনশীলতা শোনায়:
স্বাধীনতা রক্ষার গুরুত্ব-যেভাবে অটোমান সময় অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা ও বহিরাগত চাপের সম্মিলনে পতিত হয়েছিল,তেমনভাবে আমাদেরও নিজের শিক্ষা,অর্থনীতি ও প্রশাসন মজবুত রাখতে হবে।সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত ইতিহাস বুঝুন-নিজস্ব ইতিহাস ও পরিচয় না জানলে, বাইরে থেকে আসা শক্তি প্রভাব সহজ হয়। জাগরুক ভূমিকা নিন-শুধু প্রচারচিত্র দেখে সিদ্ধান্ত নয়; তথ্য-সত্য,কারণ-ফল জানার পর চূড়ান্ত মত দেওয়া নিরাপদ।বহুপাক্ষিক কূটনীতি শিখুন-বিশ্বে একরুখা শক্তির দাবিতে সমর্থন না দিয়ে, অংশীদারিত্ব ও সমতা ভিত্তিক নীতি গঠন জরুরি।
সতর্কতা বনাম গ্রহণযোগ্যতা
লুজান-এর টেবিলে যে চুক্তিগুলো লেখা হয়েছিল-সেগুলো কেবল কাগজে ছিল না; মানুষের জীবনে যন্ত্রণা, উৎখাত ও নবসংস্কারের সূত্রপাতও ছিল। লর্ড কার্জন ছিলেন ব্রিটিশ কূটনীতিক স্বার্থের প্রতীক; হাইম নাহুম ছিলেন সংখ্যালঘু প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক কুশাগ্রতার দ্যুতি (কথিত আছে তিনি পরিচয় গোপন করে কয়েকটি ভাষা শিখে মুসলিম সেজে রাজশাসনে প্রবেশ করে)। তাদের পরিচয়কে শুধু একদিক দিয়ে করা যায় না-কারণ ইতিহাস কখনোই এক মাত্র ব্যাখ্যায় সাজে না।
তুরস্ক আজ সেই অতীত-স্মৃতি থেকে শক্তি নিয়ে বাহিরে আসছে-আমাদেরও উচিত আমাদের ইতিহাস, ভাষা,identity ও সার্বভৌমত্ব মজবুত করা।হোক বা না হোক, এই উত্তরণের সংকেত একটি বার্তা-শক্তি ও ইতিহাস শুধু স্মৃতিছাড়া নয়; যদি ব্যবহার করা যায়, তবে তা ইতিহাসকে পুনরুজ্জীবিত করে।”বাংলাদেশের মানুষের জন্য আহ্বান-বলুন না,আমরা দেখছি না; বলুন, “আমরা প্রস্তুত।” প্রস্তুত ইতিহাস জানার, প্রস্তুত নিজেকে রক্ষার, প্রস্তুত অংশীদারিত্ব গড়ার, প্রস্তুত স্বাধীনভাবে এগোনোর।
লেখক: মো: আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক, নবজাগরণ (প্রকাশনার ৪৪ বছর)
অনলাইনে পড়ুন:www.thenabajagaran.com




