হাজব্যান্ড ছাড়া তো আমাদের তিনজনের কেউ নাই”-মেট্রোরেলে বেয়ারিং প্যাড পড়ে নিহত আবুল কালামের পরিবার ভেঙে চুরমার

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
মেট্রোরেল প্রকল্পে বেয়ারিং প্যাড মাথায় পড়ে নিহত শ্রমিক আবুল কালাম আজাদ-একটি নাম, একটি জীবন, একটি পরিবার, একটি ভবিষ্যৎ।যে মানুষটি প্রতিদিন সকালবেলা কাজের সাইটে যেতো শুধু সংসার চালানোর জন্য, সেই মানুষটি আজ আর নেই।দাফন হয়েছে গ্রামের বাড়িতে।কবরের পাশে দাঁড়িয়ে স্ত্রীর কণ্ঠ ফেটে ওঠে-“হাজব্যান্ড ছাড়া তো আমাদের তিনজনের কেউ নাই… আমাদের সংসার কে চালাইব?”এই একটি বাক্য পুরো রাষ্ট্রের বিবেককে কাঁপিয়ে দেয়ার মতো।

কিন্তু আমাদের রাষ্ট্র কি এখনও বিবেকবান?
আবুল কালাম আজাদ-একজন মানুষ নয়, দেশের লাখো কর্মজীবী পরিবারের প্রতিচ্ছবি তিনি কোনো অপরাধ করেননি। তিনি চুরি করেননি, কারো ক্ষতি করেননি। তিনি ছিলেন এক সহজ-সরল পরিশ্রমী মানুষ, যিনি দিনে ৮-১২ ঘণ্টা কাজ করে তিনজনের সংসার চালাতেন।তার স্ত্রী বলেন- “আমার স্বামী প্রতিদিন বলতো, আরেকটু কাজ করি, ঘরটা ঠিক করি। মাইয়া দুইটার পড়ার খরচটা জোগার করি। এখন আমি কার কাছে যাব? কে আমার মেয়েদের দেখবে?”এই কান্না কেবল এক নারীর নয়-এটি বাংলাদেশের শ্রমজীবী শ্রেণির কান্না।

নির্মাণ করি, কিন্তু রক্ষা করি না-এই ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় বাস্তবতা
মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, সেতু-সবকিছু আমরা করি গল্প তৈরির জন্য।ফিতা কাটি।উদ্বোধন করি।সেলফি তুলি।তারপর ভুলে যাই-মানুষের জীবন নিরাপত্তা কোথায়?
মেট্রোরেল প্রকল্পের মতো একটি উচ্চঝুঁকিপূর্ণ নির্মাণ এলাকায়:ঝুঁকি সতর্কতা ছিল না,বোল্ট-জয়েন্ট পরীক্ষা করা হয়নি ঠিকমতো,নিরাপত্তা বেষ্টনী ছিল না,সাইট পর্যবেক্ষণে ছিল না কোনো স্বতন্ত্র তদারকি টিম।এভাবে মৃত্যু দুর্ঘটনা নয়, এটি পরিকল্পিত অবহেলার ফল।

স্ত্রী, দুই মেয়ে-এখন অন্ধকারে ভবিষ্যৎ
আবুল কালামের পরিবারে রোজকার আয়ের কোনো উৎস নেই এখন।তিনি ছিলেন একজন স্বামী,একজন বাবা,একজন ভরসা। স্ত্রী কাঁদতে কাঁদতে বলেন-“আমাদের দুই মাইয়া স্কুলে পড়ে। আজ আইজকা খাতা-কলমের টাকা নাই। বাসার ভাড়া কিভাবে দিব? খাব কি দিমু ওদের?”

এই কান্না কেবল পরিবারের কান্না নয়-এটি রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র।এদিকে হাইকোর্টে রিট-কিন্তু রিট শুধুই কাগজ নয়, রক্তের দাবি মান নির্ণয়, রক্ষণাবেক্ষণ, নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে আইনী বাধ্যবাধকতা করার জন্য রিট দায়ের হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো-এ রিট কি দেরিতে আসেনি?এ রিট আসার আগে কতজন মারা গেছে?আর কতজন মরবে আমরা ব্যবস্থা নেওয়ার আগে?

ভুল পরিকল্পনা, অযোগ্যতা ও অদক্ষতা-রাজধানী অচল, জীবন বিপন্ন এয়ারপোর্ট এলাকায় ৬ লেন সড়ক ব্যবহার করা হচ্ছে মাত্র ২ লেন ফলে:তীব্র যানজট,অ্যাম্বুলেন্স আটকে থাকা,যাত্রীরা ফ্লাইট মিস,মায়ের কোলের সন্তান হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যায় কখনও।এটি উন্নয়ন নয়-এটি পরিকল্পনাহীনতার নির্মমতা।এটি নীতিনির্ধারকদের চরম অজ্ঞতা।

রাষ্ট্র কি শুধু স্থাপনা বানাবে, না মানুষের জীবনও রক্ষা করবে?উন্নয়ন মানে শুধু সিমেন্ট-রড নয়।উন্নয়ন মানে মানুষ।মানুষের জীবন।মানুষের নিরাপত্তা।আমরা যদি রক্ষা করতে না পারি-তাহলে নির্মাণ নয়,আমরা কবর বানাচ্ছি।

রাষ্ট্রের প্রতি দাবি:নিহত পরিবারকে আজীবন আর্থিক ভাতা। প্রকল্পে স্বতন্ত্র ২৪/৭ নিরাপত্তা ও রক্ষণাবেক্ষণ কর্তৃপক্ষ গঠন। উচ্চঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় সুরক্ষা প্রটোকল বাধ্যতামূলক। অবহেলায় দায়ীদের ফৌজদারি শাস্তি।

আবুল কালাম আজাদ আর নেই।কিন্তু তার স্ত্রীর সেই কান্নার বাক্য দেশের বাতাসে ভারী হয়ে রয়ে গেছে- “হাজব্যান্ড ছাড়া তো আমাদের তিনজনের কেউ নাই… আমাদের সংসার কে চালাইব?”এই প্রশ্ন এখন রাষ্ট্রের সামনে,আমাদের সবার সামনে,মানবতার সামনে।

লেখক: মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক-নবজাগরণ