গণভোট:রাষ্ট্রের মালিকানা ফিরে পাওয়ার ঐতিহাসিক সুযোগ

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
বাংলাদেশ আজ এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে। চারপাশে বিতর্ক,বিভাজন,উত্তেজনা-“হ্যাঁ” শিবির বনাম “না” শিবির।কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে-কয়জন মানুষ জানেন, গণভোটের বিষয়বস্তু আসলে কী? কয়জন জানেন জুলাই সনদের ৯৪ পৃষ্ঠায় কী লেখা আছে, কিংবা ৪৮টি অনুচ্ছেদে কীভাবে নতুন বাংলাদেশের রূপরেখা আঁকা হয়েছে?আজকের হুজুগে আলোচনায় যারা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ নিয়ে গলা ফাটাচ্ছেন, তারা অনেকেই জানেন না,গণভোট মানে শুধু ভোট নয়-এটা জনগণের হাতে রাষ্ট্রের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়ার এক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া।

গণভোট কী?গণভোট বা Referendum হলো এমন এক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, যেখানে কোনো রাষ্ট্রীয় বা সাংবিধানিক সিদ্ধান্ত জনগণ নিজেরাই সরাসরি দেয়।
এখানে কোনো রাজনৈতিক দল বা সংসদীয় প্রতিনিধি নয়-সিদ্ধান্ত নেন জনগণ নিজের হাতে।বিশ্বে গণভোটকে বলা হয় “সরাসরি গণতন্ত্রের প্রাণ”।নরওয়ে থেকে সুইজারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড থেকে চিলি-বহু দেশ তাদের সংবিধান,স্বাধীনতা বা নীতি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে জনগণের রায় নিয়েছে গণভোটের মাধ্যমে।

ইতিহাসে গণভোটের শক্তি:ইতিহাসে গণভোট অনেক সময় এক জাতির ভাগ্য পাল্টে দিয়েছে।১৯৩৫ সালে জার্মানির সার অঞ্চলে (Saar Basin) গণভোটে ৯০% মানুষ জার্মানিতে যুক্ত হওয়ার পক্ষে রায় দেয়। ১৯৫৮ সালে ফরাসি সোমালিল্যান্ডে গণভোট হয় নতুন সংবিধানের প্রশ্নে- যদিও তা বিতর্কিত ছিল।১৯৭৫ সালে যুক্তরাজ্যে জনগণ ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে রায় দিয়েছিল, আর ২০১৬ সালে আবার গণভোটে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়-যা গোটা ইউরোপকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।সুইজারল্যান্ডে ১৮৯১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ৭০০-রও বেশি জাতীয় গণভোট হয়েছে-প্রতিটি জনগণের সরাসরি মতামতের প্রতিফলন।এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে-গণভোট সঠিকভাবে আয়োজন করা গেলে তা হতে পারে জাতির ভাগ্যনির্ধারক হাতিয়ার।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণভোট:বাংলাদেশে ১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জনগণের অনুমোদন পেতে গণভোট আয়োজন করেছিলেন।আজ ২০২৫ সালে আবার সেই শব্দটি ফিরে এসেছে-কিন্তু এবার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা।২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের পর বাংলাদেশের জনগণ বলেছিল,“রাষ্ট্র আমাদের,কোনো দলের নয়।”
রক্ত,অগ্নি আর ত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জিত সেই বিপ্লবের লক্ষ্য ছিল একটাই-রাষ্ট্রীয় মালিকানা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া।জুলাই বিপ্লবের পর ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রপুনর্গঠনের একটি দিকনির্দেশক নথি তৈরি করে-‘জুলাই সনদ’।
৯৪ পৃষ্ঠার ৪৮টি অনুচ্ছেদে এতে তুলে ধরা হয়েছে-জনগণের সার্বভৌম মালিকানা,বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসন,সামাজিক ন্যায়, শিক্ষা-স্বাস্থ্য সংস্কার,রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতা ও সম্পদের ন্যায্য বণ্টন।এই সনদের অনুমোদন বা প্রত্যাখ্যান নিয়েই হচ্ছে বর্তমান গণভোট।

“হ্যাঁ” ও “না” যুদ্ধের অন্ধ আবেগ
আজ সামাজিক মাধ্যমে এক শ্রেণির মানুষ “হ্যাঁ” বনাম “না” যুদ্ধের উন্মাদনায় লিপ্ত।কেউ বলছেন “হ্যাঁ মানেই মুক্তি”, কেউ বলছেন “না মানেই দেশ রক্ষা।”কিন্তু প্রকৃত প্রশ্ন হলো-আপনি কি জানেন কীতে ‘হ্যাঁ’ বলছেন, আর কীতে ‘না’?যে দলিল নিয়ে ভোট হচ্ছে,আপনি কি তা পড়েছেন?
৯৪ পৃষ্ঠার ‘জুলাই সনদ’ না পড়ে অন্ধভাবে রায় দেওয়া মানে নিজের রাষ্ট্রীয় ভবিষ্যৎ অন্যের হাতে তুলে দেওয়া।
গণভোট কোনো আবেগের লড়াই নয়-এটি জ্ঞানের, যুক্তির এবং ভবিষ্যৎ নির্ধারণের লড়াই।

গণভোট-বিরোধীরা আসলে কী চায়?
আজ যারা গণভোটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন, তারা বলছেন “দেশে এখন এর সময় নয়”,“গণভোটে বিশৃঙ্খলা হবে।”কিন্তু ইতিহাস বলে-যারা জনগণের সরাসরি মতামতকে ভয় পায়, তারাই সাধারণত গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি।১৯৭৭ সালের মতো আজও গণভোট জনগণের রায় যাচাইয়ের পথ।এটি কোনো রাজনৈতিক দলের নয়-জনগণের অধিকার নির্ধারণের আয়োজন।
গণভোটের বিরোধিতা মানে আসলে জনগণের রায়কে অগ্রাহ্য করা।তারা জানে, জনগণ একবার রাষ্ট্রের মালিক হয়ে গেলে দলীয় রাজনীতির ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।
তাই আজ যারা গণভোট ঠেকাতে চায়, তারা আসলে জনগণের মালিকানা হারাতে চায়।

জুলাই সনদ: বিপ্লবের রক্তে লেখা দলিল
জুলাই সনদ কোনো কাগুজে দলিল নয়-এটি জুলাই বিপ্লবের শহীদ তরুণদের রক্তে লেখা প্রতিশ্রুতি।এর মূল দর্শন একটিই-রাষ্ট্রের প্রতিটি সিদ্ধান্তে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।এই সনদ যদি গণভোটে অনুমোদন পায়,তবে-স্থানীয় সরকার হবে প্রকৃত ক্ষমতাবান, প্রশাসন বিকেন্দ্রীকৃত হবে,সরকারি কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা আসবে,সম্পদের মালিক হবে জনগণ, কোনো গোষ্ঠী নয়।
কিন্তু যদি গণভোটে অজ্ঞতা,ভয় বা বিভ্রান্তির কারণে ‘না’ জেতে-তাহলে ফিরে আসবে পুরনো শাসনব্যবস্থা,যেখানে জনগণ থাকবে দর্শক,শাসক নয়।এখন বুঝতে চেষ্টা করুন গণভোট হচ্ছে আপনার আমার জন্য একটি সুযোগ দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক বিজয়।

গণভোট:বিপ্লবের দ্বিতীয় অধ্যায়
জুলাই বিপ্লব ছিল প্রথম ধাপ-রাস্তায় সংগ্রাম, রক্ত, আত্মত্যাগ।গণভোট সেই বিপ্লবের দ্বিতীয় ধাপ-আইনি অনুমোদন,জনগণের রায়, এবং রাষ্ট্রের নতুন দিকনির্দেশ।
এই ভোটের মাধ্যমে জনগণ নির্ধারণ করবে-রাষ্ট্রের মালিক জনগণ থাকবে,নাকি আবার ফিরে যাবে দলীয় প্রভুত্বে।

গণভোট আয়োজনের প্রয়োজনীয় শর্ত-গণভোট সাফল্য নির্ভর করে কয়েকটি মৌলিক বিষয়ের উপরঃ
স্বচ্ছ প্রশ্ন:ভোটের প্রশ্নটি সহজ, নির্দিষ্ট এবং বোধগম্য হতে হবে।যদি প্রশ্নই অস্পষ্ট হয়,জনগণ বিভ্রান্ত হবে।
জনসচেতনতা:গণভোটের আগে জনগণকে সময় ও সুযোগ দিতে হবে সনদের বিষয়বস্তু বুঝতে,বিতর্কে অংশ নিতে।
স্বাধীন প্রশাসন:গণভোট পরিচালনা করতে হবে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ একটি কমিশনের মাধ্যমে,যাতে কোনো রাজনৈতিক প্রভাব না থাকে।
ফলাফল বাস্তবায়ন:গণভোটের রায়কে সম্মান জানাতে হবে। জনগণ যে সিদ্ধান্ত নেবে,সরকারকে তা বাস্তবায়ন করতে হবে-না হলে গণতন্ত্রের ভিত্তি নড়ে যাবে।

রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, প্রজা নয়
বাংলাদেশের জনগণ কোনো দলের দাস নয়, কোনো নেতার করুণা প্রাপ্ত নয়।রাষ্ট্র এই জনগণের রক্তে গঠিত-ভাষা আন্দোলনের রফিক-শফিক, মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের আত্মত্যাগে,আর জুলাই বিপ্লবের তরুণদের সাহসী পদযাত্রায়।এই জনগণ আজ রাষ্ট্রের মালিকানা ফেরত চাইছে-দলীয় শাসনের দাসত্ব নয়।

জনগণের প্রতি আহ্বান:বন্ধুরা,গণভোট মানে শুধু ভোট নয়-এটি একটি ঐতিহাসিক পরীক্ষা।ভেবে ভোট দিন।পড়ুন জুলাই সনদ, বিশ্লেষণ করুন প্রতিটি অনুচ্ছেদ।যদি কোনো প্রস্তাব জাতীয় স্বার্থবিরোধী মনে হয়,যুক্তি দিয়ে বিকল্প দিন। অন্ধভাবে কারো অনুসারী হবেন না।আপনার একটিমাত্র ভোটই নির্ধারণ করবে-বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মালিক হবে জনগণ,নাকি আবার ফিরে যাবে প্রভুর হাতে।

গণভোট শুধু একটি প্রশাসনিক অনুষ্ঠান নয়-এটি এক জাতির আত্মপরিচয়ের পুনর্জন্ম।যদি আমরা সচেতনভাবে, যুক্তিসম্পন্নভাবে,এবং জাতির স্বার্থে অংশ নিই,তাহলে এই গণভোট হয়ে উঠবে বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন যুগের সূচনা। কিন্তু যদি এটি হয় অজ্ঞতার, বিভ্রান্তির বা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের হাতিয়ার-তাহলে ফিরে আসবে সেই পুরনো অন্ধকার,যেখানে জনগণ কেবল ভোটার,শাসক নয়। আজ তাই প্রশ্ন একটাই-আমরা কি আবার গোলামী বেছে নেব,নাকি রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক হয়ে উঠব?

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক-নবজাগরণ