নবজাগরণ বিশেষ প্রতিবেদন:
পুলিশ বাহিনীতে অনেকেই জীবনের সেরা সময়টা কাটিয়ে দেন প্রতিদিনের দায়িত্ব পালনে-দেশ, জনগণ ও প্রশাসনের প্রতি একনিষ্ঠভাবে। কিন্তু সেই নিষ্ঠার প্রতিদান কখনো কখনো হারিয়ে যায় রাজনীতির গোলকধাঁধায়। এমনই এক করুণ কাহিনি হলো ২০তম বিসিএসের একজন মেধাবী পুলিশ কর্মকর্তা,আবদুল মাবুদ দুলাল-এর জীবনের গল্প-যিনি দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে অন্যায়ের শিকার হয়ে থেকে গেছেন প্রমোশনের বাইরে, কেবল একটি ছবির কারণে।
এক মেধাবী অফিসারের হতাশায় ভরা দীর্ঘ যাত্রা:
২০০১ সালের বিসিএসের ২০তম ব্যাচ থেকে উত্তীর্ণ হয়ে পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন আবদুল মাবুদ দুলাল। সততা, দক্ষতা ও মাঠপর্যায়ের তৃণমূল অভিজ্ঞতায় তিনি দ্রুতই সহকর্মীদের মধ্যে একজন আদর্শ অফিসার হিসেবে পরিচিতি পান। সহকর্মীদের কেউ কেউ যখন ঢাকা, চট্টগ্রাম,রাজশাহী কিংবা খুলনার মতো বড় শহরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আসীন, দুলাল তখন নীরবে কাজ করে যাচ্ছিলেন প্রান্তিক জেলাগুলিতে।
তবে ২০০৯ সালের পর থেকে,রাজনৈতিক প্রভাবিত প্রশাসনিক সংস্কৃতির এক নির্মম পরিণতি এসে পড়ে তাঁর জীবনে। আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে প্রশাসনের ভেতর দলে-দলে ভাগ হয়ে যাওয়া প্রমোশন-রাজনীতি তাঁর কেরিয়ারকে স্তব্ধ করে দেয়।
যেখানে তাঁরই ব্যাচের ১৬ জন কর্মকর্তা ২০২২ সালের মধ্যেই ডিআইজি (উপ-মহাপরিদর্শক) পদে উন্নীত হয়েছেন, সেখানে আবদুল মাবুদ থেকে গেছেন পদোন্নতির জন্য অপেক্ষায়-এক অদৃশ্য নিষেধাজ্ঞার ছায়ায়।
একটি ছবির অভিশাপ:২০০৪ সালের কুমিল্লা অধ্যায়
তাঁর এই বঞ্চনার সূচনা হয় প্রায় দুই দশক আগে, ২০০৪ সালে। তখন তিনি কুমিল্লায় কর্মরত একজন তরুণ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি)। সেই সময় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায়। রাষ্ট্রীয় প্রটোকল অনুযায়ী, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কুমিল্লা সফরে গেলে স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ তাঁর নিরাপত্তা ও প্রটোকলের দায়িত্ব পালন করে।
আবদুল মাবুদও তাঁর দায়িত্ব পালন করেন রাষ্ট্রীয় নিয়ম মেনে। কিন্তু এক পর্যায়ে মিডিয়ায় প্রকাশিত হয় একটি ছবি-যেখানে দেখা যায় তারেক রহমানের সঙ্গে একই ফ্রেমে রয়েছেন এএসপি আবদুল মাবুদ। বিগত সরকার পরিবর্তনের পর, এই একটি ছবি হয়ে ওঠে তাঁর জীবনের কালো অধ্যায়। যেন রাষ্ট্রের নীতিগত দায়িত্ব পালন নয়,বরং রাজনৈতিক আনুগত্যের প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয় ছবিটি। ফল-এক অদৃশ্য “ব্ল্যাকলিস্ট”-এ ঠাঁই হয় তাঁর নাম।
সহকর্মীরা উঠে গেলেন ডিআইজি,তিনি রয়ে গেলেন স্থবির
২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত সময়ে, যাঁরা একসাথে চাকরি শুরু করেছিলেন, তাঁদের প্রায় সবাই একে একে উঠে গেছেন ডিআইজি কিংবা অতিরিক্ত আইজিপি পদে। তাঁদের মধ্যে অনেকে দফতর, গোয়েন্দা শাখা,কিংবা স্পেশাল ব্রাঞ্চে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান পেয়েছেন।আর আবদুল মাবুদ? তিনি রয়ে গেছেন স্থবির হয়ে-একই পদে,বারবার প্রমোশন বোর্ডে বাদ পড়ে।
প্রশাসনিকভাবে তাঁর ফাইলে কোনো বড় শাস্তিমূলক আদেশ নেই, অভিযোগ নেই দুর্নীতি বা দায়িত্ব অবহেলার। তবু প্রমোশন তালিকায় তাঁর নাম আসেনি। অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, “রাজনৈতিক আনুগত্য যাচাই” নামের এক অনানুষ্ঠানিক প্রথা ছিল এই বঞ্চনার মূল কারণ। আর এই “রাজনৈতিক যাচাই”-এর ভিত্তিই ছিল সেই একটি ছবি।
পদোন্নতির রাজনীতি:এক নীরব মহামারি বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে পদোন্নতি শুধু প্রশাসনিক যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে না-এটি প্রায়ই হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক পছন্দের প্রতিযোগিতা। বিগত শাসনামলে ছাত্রলীগ ব্যাকগ্রাউন্ড, রাজনৈতিক সংযোগ বা নির্দিষ্ট আনুগত্যই হয়ে উঠেছিল পদোন্নতির অব্যক্ত শর্ত। ফলে একদল দক্ষ কিন্তু “অপছন্দনীয়” অফিসার ধীরে ধীরে হারিয়ে যান অন্ধকারে, আর যোগ্যতা নয়-প্রভাব নির্ধারণ করে দেয় ভবিষ্যৎ।
নবজাগরণের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ১৫ বছরে প্রায় ৫০ জন কর্মকর্তা বিভিন্নভাবে পদোন্নতি বঞ্চিত হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই প্রশাসনের “অরাজনৈতিক” বা “নিরপেক্ষ” ভাবমূর্তির জন্য চিহ্নিত ছিলেন। এদের মধ্যে কয়েকজন অবসর নিয়েছেন ডিএসপি বা এএসপি পদেই, যেখানে তাঁদের সহকর্মীরা আইজিপির সীমানায় পৌঁছে গেছেন।
পরিবার ও সহকর্মীদের কষ্ট:দীর্ঘ বঞ্চনার এই সময়টা কেবল পেশাগত নয়, ব্যক্তিগতভাবেও আবদুল মাবুদ দুলালের জীবনে এক গভীর ছায়া ফেলে।পরিবারের সদস্যরা তাঁকে প্রায়ই দেখতে পান চুপচাপ, হতাশ। সহকর্মীদের পদোন্নতি খবরগুলো তাঁর কাছে হয়ে ওঠে একেকটি মানসিক আঘাত। তাঁর এক ঘনিষ্ঠ সহকর্মী নবজাগরণকে বলেন-“দুলাল ভাই সবসময় হাসতেন, কিন্তু চোখে একটা নিরব ক্ষত ছিল। আমরা জানতাম, তিনি অন্যায়ভাবে বঞ্চিত। কিন্তু কিছুই করতে পারিনি।”
তবু তিনি কখনোই দায়িত্ব অবহেলা করেননি।
সবসময় নিয়ম মেনে, সততার সঙ্গে কাজ করেছেন। তাঁর ফাইল খুললে দেখা যায়-দীর্ঘ ২০ বছরের চাকরিজীবনে কোনো অভিযোগ নেই, বরং একাধিক প্রশংসাপত্র ও সেবা পুরস্কার রয়েছে।
নতুন সময়, নতুন আশা:২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশ যখন পরিবর্তনের পথে, তখন এই দীর্ঘ বঞ্চনার গল্পগুলো নতুনভাবে আলোচনায় আসছে।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস ঘোষিত রাষ্ট্রীয় প্রশাসন সংস্কার নীতিতে এখন জোর দেওয়া হচ্ছে “মেধা ও ন্যায়ভিত্তিক পদোন্নতি ব্যবস্থায়।”সেখানে স্পষ্টভাবে বলা
হয়েছে-“রাজনৈতিক আনুগত্য নয়,পেশাগত যোগ্যতা ও সততা হবে পদোন্নতির একমাত্র মাপকাঠি।”
এই নীতির আলোকে এখন অনেক কর্মকর্তা নতুন করে আশার আলো দেখছেন।আবদুল মাবুদ দুলালও সেই আশাবাদীদের একজন। হয়তো এবার তাঁর ১৫ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটবে।
নবজাগরণ বিশ্লেষণ:প্রশাসনের ন্যায়বোধ ফিরিয়ে আনতে হবে আবদুল মাবুদের গল্প শুধু একজন কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ক্ষোভ নয়-এটি রাষ্ট্রীয় ন্যায়বোধ হারানোর একটি প্রতিচ্ছবি। যখন একজন কর্মকর্তার নিয়তির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় রাজনীতির হাতে, তখন শুধু ব্যক্তি নয়, পুরো প্রশাসনিক কাঠামো আক্রান্ত হয়। একজন যোগ্য অফিসার বঞ্চিত হলে-জনগণের নিরাপত্তা, সুশাসন ও ন্যায়ের ভিত্তিই নড়ে যায়।
পুলিশ বাহিনীর মতো শৃঙ্খলাবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে যদি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা প্রমোশনের মাপকাঠি হয়ে ওঠে, তবে মেধা ও সততা সেখানে টিকবে না। তাই এখনই সময়,রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি “Promotion Justice Board” গঠন করার-যেখানে যোগ্যতা, সেবা, মানবিক মূল্যায়ন এবং স্বচ্ছ যাচাই প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
একটি রাষ্ট্রের মর্যাদা নির্ভর করে তার প্রশাসনের ন্যায্যতায়।
আর আবদুল মাবুদ দুলাল-এর মতো নীরব যোদ্ধারা-যারা অন্যায়ের মাঝেও দায়িত্ব পালন করে গেছেন-তাঁদের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হবে কিনা, সেটাই এখন নতুন রাষ্ট্রযাত্রার পরীক্ষার ক্ষেত্র।
অনলাইনে পড়ুন:www.thenabajagaran.com





