পুলিশে পদোন্নতিবঞ্চনা :ফ্যাসিবাদী উত্তরাধিকারের ছায়া ও ন্যায়ের নতুন ডাক

বিশেষ প্রতিবেদন:প্রকাশ:৩১ অক্টোবর ২০২৫
বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী-একটি প্রতিষ্ঠানের নাম নয়,এটি রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা,নিরাপত্তা এবং নাগরিক মর্যাদার প্রতীক। কিন্তু সেই বাহিনীর ভেতরেই আজ জমে আছে দগদগে ক্ষোভ,দীর্ঘদিনের বঞ্চনা আর রাজনৈতিক শোষণের গভীর ক্ষত।

ফ্যাসিবাদী আমলে পদোন্নতির নামে দাসত্ব:
২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত শেখ হাসিনার শাসনামলে পদোন্নতির একমাত্র মাপকাঠি হয়ে দাঁড়ায় দলীয় আনুগত্য ও ‘ছাত্রলীগ ব্যাকগ্রাউন্ড’।যারা মেধাবী,যাদের বুকে দেশপ্রেম ছিল,কিন্তু রাজনীতিক দাসত্বে মাথা নত করেননি-তাদের ভাগ্যে জোটে নির্বাসন,বদলি,মিথ্যা গোয়েন্দা প্রতিবেদন,এবং বছরের পর বছর ওএসডি জীবন।একজন বঞ্চিত ডিআইজি পর্যায়ের কর্মকর্তা নবজাগরণকে বলেন-“আমরা জনগণের পক্ষে ছিলাম,তাই ফ্যাসিবাদ আমাদের শত্রু বানিয়েছিল। দলীয় পরিচয় ছাড়া পদোন্নতির স্বপ্ন দেখাটাই ছিল অপরাধ।”

বঞ্চিতদের দীর্ঘ সারি:বিসিএস ১৫,১৬,১৮ ও ২০তম ব্যাচের ১০১ জন কর্মকর্তা আজও ন্যায্য মূল্যায়নের অপেক্ষায়। তাদের অনেকেরই পদোন্নতির ফাইল পড়ে আছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের টেবিলে-ধুলায় ঢাকা,নড়চড় নেই।একজন কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন-“প্রতি সপ্তাহে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের সভা হয়,কিন্তু পুলিশের পদোন্নতি ফাইল কেউ তোলেন না। কেন? কার স্বার্থে?”

ব্যারিস্টার জিল্লুর রহমান:অন্যায়ের বিরুদ্ধে পুলিশের মুখ
বিসিএস ১৫তম ব্যাচের সাহসী কর্মকর্তা ব্যারিস্টার জিল্লুর রহমান শেখ হাসিনার অন্যায় আদেশ মানেননি-এ কারণেই দু’বার চাকরি হারান।একবার আদালতের নির্দেশে,আরেকবার নির্বাহী আদেশে ফিরে এলেও,পদোন্নতির ক্ষেত্রে রয়ে গেছেন বঞ্চিত।তার ব্যাচমেটরা এখন অতিরিক্ত আইজিপি,কিন্তু তিনি ৫ আগস্ট বিপ্লবের পর এসপি থেকে সরাসরি ডিআইজি হয়েছেন।তার কণ্ঠে তীব্র অভিমান-“আমি যদি দলীয় পদলেহন করতাম,হয়তো আজ আইজিপিও হয়ে যেতাম। কিন্তু আমি জনগণের পুলিশ,দাস নই।”

আবদুল মাবুদ দুলাল;আশিক সাঈদ;জাহিদুল হাসান:মেধা ছিল অপরাধ:২০তম ব্যাচের প্রথম হয়েছিলেন আশিক সাঈদ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন বলেই তাকে“শিবির ঘেঁষা”তকমা দেওয়া হয়।একই ব্যাচের আরেক কর্মকর্তা আবদুল মাবুদ দুলাল-২০০৪ সালে তারেক রহমানের সফরে ডিউটি পালন করায় ১৮ বছর পদোন্নতি পাননি।গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কমিশনার জাহিদুল হাসান-শুধু ভাই বিএনপি পরিবারের হওয়ায় তারও পদোন্নতি বন্ধ।একজন সহকর্মী বলেন-“আমাদের অপরাধ ছিল মেধা,সততা ও রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা। সেটাই আওয়ামী শাসনের চোখে রাষ্ট্রদ্রোহ।”

শূন্য পদ থাকলেও পদোন্নতি নেই:বর্তমানে অতিরিক্ত আইজিপি পদে ১টি ও ডিআইজি পদে ৩২টির বেশি পদ ফাঁকা।
৫ আগস্টের পর বৈষম্যবিরোধী সরকার ক্ষমতায় এলেও এখনো সেই পদগুলো পূরণ হয়নি।স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন-“সব ফাইল প্রস্তুত। ইতিবাচক গোয়েন্দা প্রতিবেদনও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কে যেন কোথাও থামিয়ে রেখেছে প্রক্রিয়াটা।”

ফাইল আটকে আছে-রাষ্ট্রের আত্মা আটকে আছে
এই বঞ্চনা কেবল ব্যক্তিগত নয়-এটি রাষ্ট্রের নৈতিক মেরুদণ্ডে আঘাত।যারা ফ্যাসিবাদী শাসনের সময় নির্ভয়ে জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন,তাদের ন্যায্য সম্মান ফিরিয়ে না দিলে নতুন বাংলাদেশ তার দাবি হারাবে।

নতুন রাষ্ট্রচিন্তার অপরিহার্যতা:বঞ্চিত কর্মকর্তাদের দাবি শুধু পদোন্নতির নয়-এটা রাষ্ট্রীয় ন্যায় ও প্রশাসনিক সংস্কারের প্রতীক।তারা বলছেন-“আমরা রাজনীতি চাই না,ন্যায্যতা চাই। পুলিশ যেন জনগণের হয়,কোনো দলের নয়-এটাই আমাদের লড়াই।”

এ মুহূর্তে সরকার যদি সত্যিই “বৈষম্যবিরোধী”হয়,তাহলে দ্রুত সব ফাইল পুনর্মূল্যায়ন, বঞ্চিতদের সম্মানজনক পদোন্নতি ও একটি স্বাধীন পুলিশ সার্ভিস কমিশন গঠনের ঘোষণা দিতে হবে।না হলে,এই ক্ষোভই পরিণত হবে রাষ্ট্রের ভিত কাঁপানো জনঅসন্তোষে।

এখনই সময়-পুলিশে ন্যায়বিচার ফিরিয়ে আনার।
এটা শুধু পুলিশের নয়,এটা জনগণের যুদ্ধ।রাষ্ট্রের পুনর্গঠন মানে প্রশাসনের পুনর্জন্ম।যেখানে পদোন্নতি হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে,রাজনৈতিক বশ্যতার নয়।