-মো: আবু তাহের পাটোয়ারী:
মানুষের ইতিহাসে কিছু ধারণা আছে যা সভ্যতার অগ্রগতির জন্য নয়, বরং মানবতার বিনাশের ভিত্তি তৈরি করেছে। “জায়নবাদ” তারই এক অন্ধকার উদাহরণ। এটি কোনো ধর্মীয় মুক্তির আন্দোলন নয়-বরং ইউরোপীয় বর্ণবাদ, ঔপনিবেশিকতা এবং ভূরাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের এক সম্মিলিত সন্তান। এর পিতা থিওডর হার্জেল, যিনি ১৮৯৬ সালে “দ্য জিউইশ স্টেট” বই লিখে বিশ্ব রাজনীতিতে এমন এক আগুন জ্বালিয়ে দেন যার শিখায় আজও জ্বলছে ফিলিস্তিন।
হার্জেলের চিন্তা: নিপীড়নের বিরুদ্ধে নয়, আধিপত্যের জন্য
হার্জেলকে অনেকে ইহুদিদের মুক্তিদাতা ভাবেন। কিন্তু তার চিন্তা ছিল না ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে-বরং বর্ণভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদের উপর। ইউরোপে ইহুদিবিদ্বেষের প্রেক্ষাপটে তিনি উপলব্ধি করেন, ইউরোপের মূল সমাজে মিলেমিশে থাকা সম্ভব নয়। তাই তিনি প্রস্তাব দেন-ইহুদিদের জন্য ইউরোপের বাইরে “একটি জাতিগত রাষ্ট্র” গঠন করতে হবে। লক্ষ্য ছিল আত্মরক্ষা নয়, একক ধর্মীয় জাতিসত্তার নামে নতুন এক ভূখণ্ড দখল করা।
এই ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় জায়নবাদ-এক রাজনৈতিক মতবাদ, যার মূল বক্তব্য ছিল: “ইহুদিদের জন্য একটি জাতিগত রাষ্ট্র চাই, পৃথিবীর যেখানেই হোক।” এই ধারণাই পরবর্তীতে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদী শক্তিগুলোর জন্য এক আদর্শ হাতিয়ার হয়ে ওঠে।
১৮৯৭ সালের বিশ্ব জায়নবাদী কংগ্রেস: আধুনিক উপনিবেশের নকশা ১৮৯৭ সালে সুইজারল্যান্ডের বেসেল শহরে প্রথম বিশ্ব জায়নবাদী কংগ্রেসে হার্জেল ও তার অনুসারীরা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন-“ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই আমাদের লক্ষ্য।”এটি শুধু একটি ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বৈঠক ছিল না; এটি ছিল বিশ্ব ইতিহাসে উপনিবেশিকতার নতুন অধ্যায়ের সূচনা।হার্জেল বুঝেছিলেন, এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন হবে সাম্রাজ্যবাদীদের সমর্থন-বিশেষ করে ব্রিটেন, জার্মানি ও রাশিয়ার মতো শক্তিধর জাতিগুলোর। তাই শুরু হয় কূটনৈতিক দরকষাকষি, ঘুষ, চুক্তি ও প্রভাব বিস্তারের এক দীর্ঘ অধ্যায়।
ঔপনিবেশিকদের সঙ্গে আঁতাত
হার্জেল প্রথমে জার্মানির কায়সার উইলহেম এবং পরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রস্তাব দেন-সিনাই, সাইপ্রাস, এমনকি পূর্ব আফ্রিকার কোনো অংশেও যদি অনুমতি দেওয়া হয়, সেখানে ইহুদিদের উপনিবেশ গঠন করা যেতে পারে।ব্রিটেন তখনও মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বিস্তারের কৌশল খুঁজছে। হার্জেলের এই প্রস্তাব তাই তাদের কানে সোনার মতো শোনায়। ফিলিস্তিন, যা ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিল, হয়ে ওঠে পরবর্তী ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র।
১৯০১ সালে হার্জেল স্বয়ং ওসমানীয় সম্রাট দ্বিতীয় আবদুল হামিদ-এর কাছে আবেদন করেন-“আমাদের ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপনের অনুমতি দিন, আমরা সাম্রাজ্যের ঋণ শোধ করে দেব।”সম্রাট দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন-“ফিলিস্তিন আমার শরীরের এক অঙ্গ। আমি এটি কেটে দিতে পারি না।”
এই প্রত্যাখ্যানের পরই জায়নবাদীরা আরও গভীরভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নেয়। এভাবেই জায়নবাদ পরিণত হয় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক রাজনীতির অংশে-একটি “ঔপনিবেশিক প্রকল্প” হিসেবে।
হার্জেলের মৃত্যু ও জায়নবাদের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার
১৯০৪ সালে মাত্র ৪৪ বছর বয়সে হার্জেল মারা যান। কিন্তু তার ধারণা তখন আর কেবল এক ব্যক্তির চিন্তা ছিল না-এটি পরিণত হয়েছিল এক আন্তর্জাতিক আন্দোলনে।
ব্রিটেন ১৯১৭ সালে বেলফোর ঘোষণা প্রকাশ করে, যেখানে তারা “ইহুদিদের জন্য একটি জাতীয় আবাসভূমি” গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়-যা মূলত ফিলিস্তিন দখলের বৈধতা তৈরির প্রথম নথি।
এই ঘোষণার মাধ্যমে হার্জেলের স্বপ্ন বাস্তবায়নের মঞ্চ প্রস্তুত হয়, এবং ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের মাটি রক্তে রঞ্জিত করে জন্ম নেয় দখলদার রাষ্ট্র ইসরায়েল।হার্জেলের উত্তরাধিকার: মানবতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রনীতি হার্জেল যে ধারণা সৃষ্টি করেছিলেন, তা আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনে গণহত্যা, জাতিগত নিধন ও নির্বাসনের রূপে টিকে আছে।
তার দেহাবশেষ ১৯৪৯ সালে দখলকৃত জেরুজালেমে স্থানান্তর করা হয়-যেখানে আজ ইসরায়েলের নেতৃত্ব তার নাম ব্যবহার করে আগ্রাসনের “বৈধতা” খোঁজে।
একজন চিন্তাবিদ হিসেবে নয়, হার্জেল ইতিহাসে স্মরণীয় একজন নৃশংস মতবাদের জন্মদাতা হিসেবে-যিনি মানবজাতিকে শিখিয়েছেন কীভাবে ধর্ম, নিপীড়ন ও রাষ্ট্রনীতিকে ব্যবহার করে অন্য জাতির ভূমি লুণ্ঠন করা যায়।
ইতিহাসের রায়: জায়নবাদ কোনো মুক্তির আন্দোলন নয়; এটি একটি বর্ণবাদী উপনিবেশিক নীতি, যার উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনি জাতিকে অস্তিত্বহীন করা।হার্জেল হয়তো মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, “আজ আমি স্বপ্ন দেখেছি; কাল পৃথিবী তা দেখবে।”হ্যাঁ, পৃথিবী দেখেছে-তার স্বপ্নের বাস্তবায়ন মানে ছিল শিশুদের রক্ত, ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘর, দখলকৃত ভূমি, আর এক অবিরাম প্রতিরোধের ইতিহাস।
আজ, একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা নতুন এক সত্যের মুখোমুখি-জায়নবাদের অবসান ছাড়া মানবতার মুক্তি সম্ভব নয়।কারণ, এই আন্দোলন শুধু ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে নয়; এটি মানুষের বিবেক, ন্যায়বোধ ও আন্তর্জাতিক নৈতিকতার বিরুদ্ধে এক অবিরাম যুদ্ধ।
অনলাইনে পড়তে:www.thenabajagaran.com
				
															
															



