মোঃ আবু তাহের পাটোয়ারী:
অনলাইনে প্রকাশিত: www.thenabajagaran.com
উত্তরবঙ্গের মানুষরা আজ মোটেই অচেনা কোনো যুদ্ধমহল থেকে কথা বলছে না-এটি তাদের প্রতিদিনের জীবন, মাঠ, বাজার, স্কুল ও মসজিদের ওপর ছায়ার মতো নেমে আসা অনিশ্চয়তা। সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিবেশী দেশের ইস্টার্ন কমান্ড সিলিগুড়ি করিডোর ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় কয়েকটি নতুন মিলিটারি গ্যারিসন/স্টেশন দ্রুত কার্যকর করেছে-বামুনি/ধুবড়ি (Dhubri/Bamuni), কিশানগঞ্জ (Kishanganj) ও চোপড়া (Chopra)। এগুলো কেবল ভৌগোলিকভাবে নিকট-এগুলি নীতিগত, কূটনৈতিক ও মানবিক গুরুত্বে আমাদের জনগোষ্ঠীর জন্য বড় প্রশ্ন তোলে।
আমি এই লেখায় একটিই বার্তা বারবার জানাতে চাই: ভয় নয়-সচেতনতা; উল্টো প্রতিক্রিয়া নয়-সংগঠিত, আইনভিত্তিক ও অহিংস প্রতিবাদ। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে হলে যে পথটি সবচেয়ে সুরক্ষিত ও ঐতিগ্রাহী-সেটি হলো শক্তিশালী কূটনীতি, জাতীয় ঐক্য (দল নয়, দেশের কল্যাণ), আন্তর্জাতিক আইনি চ্যানেল এবং জনকল্যাণমুখী নিরাপত্তা নীতি। অস্ত্রায়ন বা গেরিলা-আহ্বান এই লেখার উদ্দেশ্য নয়-এগুলো সমাজকে ভেঙে দেবে এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করবে সাধারণ মানুষকে।
খবরটি কী বলছে-কিসে উদ্বিগ্ন আমরা
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ও বিভিন্ন রিপোর্টে বলা হচ্ছে-ইস্টার্ন কমান্ডে অন্তর্ভুক্ত করে ধুবড়ি/বামুনিতে নতুন মিলিটারি স্টেশন গড়া হচ্ছে এবং কিশানগঞ্জ ও চোপড়া এলাকাতেও দ্রুত গ্যারিসন স্থাপন করা হয়েছে; এসব দ্রুততরে কার্যকরিকরণ করা হয়েছে যাতে সিলিগুড়ি করিডোরের নিরাপত্তা ঘনিষ্ঠভাবে রাখা যায়। এসব স্থাপনের উদ্বুদ্ধতা ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের বক্তব্য দিচ্ছে; তবে এই পদক্ষেপগুলোর বাস্তব প্রভাব আমাদের সীমান্তবর্তী জনগণের উপর কতটা-সে প্রশ্ন এখনই তুলতে হবে।
চোপড়া ‘Chopra Defence Land’ নামেও উল্লেখিত হয়েছে-এটি পঞ্চগড় জেলার Tetulia (টেটুলিয়া)-র খুব কাছাকাছি পদে অবস্থান করে বলে একাধিক রিপোর্টে বলা হয়েছে; অর্থাৎ আমাদের দেশের রানপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ের মানুষদের নিকট এটি সরাসরি পর্যবেক্ষণমূলক মানে বহন করে। এর কারণেই স্থানীয় মানুষদের মধ্যে উদ্বেগ স্বাভাবিক।
ভয়ের আগেই প্রশ্ন: স্বচ্ছতা চাই-গুজব নয়, তথ্য
যে কোনো সীমান্তগত আশঙ্কায় প্রথম কর্তব্য হচ্ছে সরকারি স্বচ্ছতা দাবি করা। সীমান্তে কীভাবে নতুন স্থাপনাগুলি গড়ে উঠল-কখন, কেন, কী পর্যায় পর্যন্ত স্থায়ী-এই প্রশ্নগুলো জনগণের কাছে পরিষ্কার হতে হবে। তথ্যের ঘাটতি থাকলে গুজব, ভয় এবং বিভ্রান্তি দ্রুত বিস্তার করে, যা রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা বাড়ায়। তাই আমাদের প্রশাসনকে জনসমক্ষে খোলাখুলি ব্যাখ্যা দিতে হবে-জনগণের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে এবং স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকা রক্ষার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
আমি পুনরায় বলি: প্রশ্ন করা অপরাধ নয়-এটা নাগরিক দায়িত্ব। যাদের জীবন সীমান্তের সঙ্গে যুক্ত, তাদের অধিকার আছে জানতে, বুঝতে এবং নিরাপত্তা দাবি করতে।
অস্ত্র নয়-মানবিক প্রস্তুতি ও সিভিল রেজিলিয়েন্স
আহামরি করে বলতে চাই: গেরিলা বা সশস্ত্র আচরণকে উৎসাহ দেই না-এটি দেশের এবং মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু। কিন্তু নাগরিক প্রস্তুতি মানে ঠিক কী? তা হলো- নিরাপদ সেফ জোন, জরুরি চিকিৎসা (first aid) শেখানো, শিশু ও বৃদ্ধদের সুরক্ষায় কার্যকর পরিকল্পনা, খাদ্য ও পানি মজুদ,এবং তাত্ক্ষণিক যোগাযোগ লাইন তৈরির মতো মানবিক ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা। এই ধরনের প্রস্তুতি মানুষকে বাঁচাতে পারে; রাজনৈতিক উত্তেজনা নয়, মানুষের জীবনই আমাদের প্রথম চাহিদা।
গ্রাম ও শহর-দুই জায়গাতেই স্থানীয় প্রশাসন ও কমিউনিটির সঙ্গে সমন্বয় করে সিভিল রেজিলিয়েন্স গঠন করুন। স্কুল-কলেজ, ক্লিনিক, মসজিদ/মন্দির-এসবকে সেফ-রিলিফ হাব হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। মিডিয়ার মিথ্যা খবর চিনে ফেলার প্রশিক্ষণ ও জরুরি-
কারণ অপ্রমাণিত উপাত্তই অনেক সময় উত্তেজনার অগ্নি জ্বালায়।
কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক আইনি চ্যানেল-আমাদের প্রধান অস্ত্র-যদি প্রতিবেশী কোনো পদক্ষেপ আমাদের সার্বভৌমত্ব বা সীমান্তবাসীর কল্যাণ-কল্যাণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে-তাহলে মোকাবিলা কেবল বন্দুক-অস্ত্রের মাধ্যমে নয়, আন্তর্জাতিক কূটনীতি, প্রমাণভিত্তিক রিপোর্ট, উপগ্রহ-চিত্র, স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষণ ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সামনে বিষয়টি তুলে ধরে করা উচিত। রাষ্ট্রীয় কূটনীতির মাধ্যমে বিষয়টি আন্তর্জাতিক মনোযোগে আনলে, অকারণে উত্তেজনা কমে এবং প্রয়োজনীয় সমাধান খোঁজার পথ সহজ হয়। এসব ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক সংস্থা, মানবাধিকার সংগঠন ও পেশাদার বিশ্লেষকদের মতামত নেওয়া উচ্চতর যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিরক্ষা-প্রকৃত নিরাপত্তার মাপকাঠি-সীমান্তের মানুষের প্রকৃত নিরাপত্তা আসে তাদের জীবিকার স্থিতিশীলতা ও সামাজিক কল্যাণ থেকে। বিদেশি সামরিক স্থাপনাগুলি যদি তাদের আয়-রোজগারের পথকে বাধাগ্রস্ত করে, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে অসন্তোষ ও অনিশ্চয়তা বেড়ে যাবে। তাই সীমান্ত অঞ্চলে দ্রুত উন্নয়নমূলক কাজ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সম্প্রসারণ,বাজার-সংযোগ ও কৃষি-সহায়তা-এসবই হলো প্রকৃত ‘প্রতিরক্ষা’। মানুষের জীবন-মান উন্নত হলে শত্রুতার প্ররোচনাও কমে।
মিডিয়ার দায়িত্ব-তথ্য যাচাই ও দায়িত্বশীলতা
সংবাদকর্মীদের ওপর বিশেষ দায়িত্ব আছে-তথ্য যাচাই করে এবং প্রমাণের সঙ্গে রিপোর্ট করা। সোশ্যাল মিডিয়ায় যে ইনফো ছড়ায় তা সবসময় নির্ভুল নয়; নাগরিকদেরও শেয়ার করার আগে যাচাই করা উচিত। আমরা তথ্যভিত্তিক সমাজ গড়তে চাই; সুতরাং মিডিয়ার পেশাগত সততা বজায় রাখতে হবে। স্থানীয় সাংবাদিকরা যদি নির্ভীকভাবে তথ্য অনুসন্ধান করে-সরকারী নথি, স্যাটেলাইট ছবি বা স্থানীয় সাক্ষীদের বিবৃতি সংগ্রহ করে-তবে জনগণ সঠিকভাবে অবগত হবে এবং গুজবের স্থান আর থাকবে না।
রাজনৈতিক কৌশল: দলের ছায়া নয়-দেশের সুরক্ষা
দেশকে রক্ষা করা কোনো দলের রাজনৈতিক প্রাপ্তি নয়-এটি সমগ্র জাতির কর্তব্য। রাজনীতিকরা যদি ব্যক্তিগত স্বার্থে সীমান্ত-ঘটনাকে ব্যবহার করেন, তবেই ক্ষতিই হবে। আমাদের চাওয়া হবে-স্বচ্ছ কূটনীতি, জাতীয় কৌশল ও স্থানীয় জনগণের কল্যাণকে কেন্দ্র করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। প্রধান উপদেষ্টা ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব এখানে গুরুত্বপূর্ণ-তারা যদি প্রমাণভিত্তিক কৌশল গ্রহণ করে, আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়টি তুলে ধরে এবং নাগরিক নিরাপত্তা জোরদার করে,তবে উত্তেজনা কায়েমের পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুলে যাবে।
জাগ্রত হও-কিন্তু অহিংসতা ও আইন ভঙ্গ করবে না
উত্তরবঙ্গের প্রত্যেক গ্রাম-নগরের মানুষকে আমার অনুরোধ একটাই-জেগে ওঠো, অবস্থান নিরপেক্ষভাবে চিহ্নিত করো, প্রশ্ন করো, দাবী তুলো-কিন্তু সবকিছুই আইন ও মানবিকতার সীমানার মধ্যে রেখে করো। কাগজ-পত্রে দাবি দাখিল করো, স্থানীয় সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহে সাহায্য করো, এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিষয়টি তুলে ধরার জন্য শান্তিপূর্ণ প্রচারণা চালাও। আমাদের সর্বশ্রেয় অস্ত্র হবে-প্রমাণ, আইন, কূটনীতি এবং একটি সংগঠিত জনআন্দোলন যা অশান্তি নয়, ন্যায়ের দাবিই করে।
এই কলামটি আমি নবজাগরণ ও অনলাইনে পাঠক ও সীমান্তবাসীর কাছে উৎসর্গ করছি-আমাদের লক্ষ্য থাকবে: জীবনের নিরাপত্তা বজায় রাখা, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা, এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রমাণভিত্তিকভাবে আমাদের অবস্থান শক্ত করা। আমরা গেরিলার গান ডাকব না; আমরা আইনের গান গাইব-আর সেটাই আমাদের শক্তি।
লেখক: মোঃ আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক, নবজাগরণ
অনলাইন প্রকাশিত: www.thenabajagaran.com
ফেসবুক শেয়ার: https://www.facebook.com/share/v/17gLhygRQe/





