একটি রাষ্ট্রনৈতিক সতর্কবার্তা ও সাংবিধানিক বিশ্লেষণ
মোঃ আবু তাহের পাটোয়ারী:
বাংলাদেশের ইতিহাসে আজ আমরা এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি,যেখানে একটি ভুল সিদ্ধান্ত জাতিকে ফের রক্ত, ষড়যন্ত্র ও রাষ্ট্রবিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে। প্রশ্নটি এখন কেবল রাজনৈতিক নয়-এটি রাষ্ট্রবিজ্ঞান,সংবিধান, এবং জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন। আজ যে গণভোট নিয়ে এত বিতর্ক, তার মূল অর্থ বোঝা জরুরি। এই গণভোট কেবল “হ্যাঁ” বা “না” এর প্রশ্ন নয়-এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামোর বৈধতা পুনঃস্থাপন এবং নতুন যুগের সংবিধানিক ভিত্তি নির্ধারণের প্রশ্ন।
গণভোটের প্রশ্নের অর্থ:এই গণভোটের মাধ্যমে জাতি উত্তর দেবে-আমরা কি জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে ঘোষিত“জনতার অন্তর্বর্তী সরকার” ও নতুন পথের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে স্বীকৃতি দিচ্ছি,না পুরনো ব্যর্থ সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চাই? “হ্যাঁ” মানে-আমরা নতুন সংবিধানিক পথ,নাগরিক গণতন্ত্র ও জনতার রাষ্ট্র নির্মাণের পক্ষে।“না” মানে-আমরা পুরনো, দুর্নীতিগ্রস্ত,দলনির্ভর সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চাই।এই ভোটের ফলেই নির্ধারিত হবে আগামী নির্বাচন কোন কাঠামোয় হবে,কে তত্ত্বাবধায়ক,এবং রাষ্ট্রের মৌলিক আইনি দিকনির্দেশনা কী হবে।
কেন গণভোট আগে হওয়া জরুরি?
সংবিধানবিজ্ঞানের একটি মৌলিক নীতি হলো-জনগণের সম্মতি ব্যতীত কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বৈধতা পায় না।
আজকের বাংলাদেশে সেই সম্মতি প্রশ্নবিদ্ধ, কারণ জুলাই বিপ্লবের পর পুরনো সংবিধান কার্যত অকার্যকর।তাই প্রথমে গণভোট না হলে-নির্বাচনের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে,দ্বৈত প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি হবে,রাষ্ট্রযন্ত্রের অভ্যন্তরে বিভাজন সৃষ্টি হবে,আর সেই বিভাজনের সুযোগ নেবে বিদেশি গোয়েন্দা ও অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রকারীরা।ফল-একটি নতুন পিলখানা ধরনের জাতীয় ট্র্যাজেডি অনিবার্য হয়ে উঠবে।
দুটি নির্বাচনের কাঠামো একসাথে কেন সম্ভব নয়
সংসদ নির্বাচন একটি প্রতিনিধি নির্ধারণমূলক ভোট-যেখানে দল বা প্রার্থীকে নির্বাচিত করা হয়।কিন্তু গণভোট হলো রাষ্ট্র কাঠামো নির্ধারণমূলক ভোট-যেখানে জনগণ সিদ্ধান্ত নেয় “আমরা কোন ব্যবস্থায় শাসিত হবো”।
এ দুটি প্রক্রিয়া একসাথে চালালে:প্রশাসনিকভাবে বিপুল বিভ্রান্তি তৈরি হবে,আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ কঠিন হবে,এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, ভোটের ম্যান্ডেটের মানে নিয়ে সাংবিধানিক যুদ্ধ শুরু হবে।একদল বলবে “জনগণ সরকারকে অনুমোদন দিয়েছে”, আরেকদল বলবে “না, তারা শুধু প্রার্থী নির্বাচন করেছে।”ফল-একই দেশের ভিতর দুই সংবিধানের যুদ্ধ।
শেখ হাসিনার পালানো বনাম জুলাই বিপ্লবের রূপান্তর
যদি শেখ হাসিনা জোর করে ক্ষমতায় থেকে আরও ৫ বছর শেষ করতেন,বাংলাদেশ তখন ক্রমে উত্তপ্ত হয়ে উঠত-রাষ্ট্রে সামরিকীকরণ,রোহিঙ্গা সংকট, সীমান্তে উত্তেজনা, খাদ্য সংকট-সব মিলিয়ে আরেকটি ৭৫ বা পিলখানা ট্র্যাজেডি অপেক্ষা করছিল।জুলাই বিপ্লব সেই রক্তস্নান ঠেকিয়েছে, রাষ্ট্রকে দিয়েছে এক রাজনৈতিক রিসেটের সুযোগ। এখন যদি সেই সুযোগ গণভোটের মাধ্যমে বৈধ রূপ না পায়, তবে আবারও “রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সেনা-বেসামরিক দ্বন্দ্ব”, “অবৈধতার দায় এড়াতে চক্রান্ত”, এবং “বিদেশি হস্তক্ষেপ” শুরু হবে। এটাই পিলখানা ঘটনার মূল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পুনরাবৃত্তি।
গণভোটের ফলাফল যাই হোক,তার ভিত্তিতে নির্বাচন
গণভোটে যদি “হ্যাঁ” জয়ী হয়-তবে নতুন সংবিধান, নতুন সংসদ কাঠামো ও বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসন নিয়ে অগ্রসর হবে রাষ্ট্র।আর যদি “না” জয়ী হয়-তবে জনগণ স্পষ্ট করে জানিয়ে দেবে তারা পুরনো সংসদীয় ব্যবস্থায় ফিরে যেতে চায়, এবং তখন নতুনভাবে একটি অন্তর্বর্তী প্রক্রিয়া তৈরি করতে হবে। কিন্তু গণভোট ছাড়া সরাসরি নির্বাচন মানে-অবৈধ সংবিধান + অবৈধ সরকার + অবৈধ রাষ্ট্রীয় আনুগত্য,যার শেষ ফল হয় রক্তপাত, নয় দাসত্ব।
বিপ্লবকে বৈধতা দিন,ষড়যন্ত্রকে নয়
বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে একটিই ঐতিহাসিক দায়িত্ব-গণভোটের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট নিশ্চিত করা।যদি এই ধাপটি উপেক্ষা করা হয়,তাহলে রাষ্ট্রের গভীরে চলমান লুকানো শক্তিগুলো জেগে উঠবে-যেভাবে ২০০৯ সালে সেনা-বেসামরিক বিভাজন ঘটেছিল, সেভাবেই আবার ঘটতে পারে একটি “রাষ্ট্রীয় বিদ্রোহ”।জুলাই বিপ্লবের ডাক ছিল “জনগণের হাতে রাষ্ট্র ফিরিয়ে দাও।”সেই বিপ্লবকে সম্পূর্ণ করার একমাত্র উপায়-গণভোট আগে, তারপর নির্বাচন।
“যে জাতি নিজের ভোটের ধরন ঠিক না করে নির্বাচন করে,সে জাতি নিজের ভবিষ্যৎকে বিকিয়ে দেয়।”
মোঃ আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক, সাপ্তাহিক নবজাগরণ




