মো: আবু তাহের পাটোয়ারী :
“রাষ্ট্রের দায়িত্ব জনগণের সেবা, না যে-করেই হোক শাসকের দাসত্ব রক্ষা?”
এই প্রশ্নের উত্তর এক রক্তাক্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট। সেদিন বাংলাদেশের রাজপথে চলছিল এক অসামান্য দৃশ্যপট-একদিকে রক্তাক্ত জনতা, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় অস্ত্রধারীরা। আর ঠিক এই রক্তস্নাত প্রেক্ষাপটে, কিছু সৎ ও মানবতাবোধসম্পন্ন জুনিয়র সেনা অফিসার ইতিহাসের গতিপথ বদলাতে সাহসী ভূমিকা রাখেন।
ওয়াকার-মুনাফিক শাসনের পতনের সূচনাবিন্দু:
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ও তার বোনজামাই ওয়াকার-ভারতের দোসর হয়ে বাংলাদেশে এক দুর্নীতিগ্রস্ত, ফ্যাসিবাদী, রাষ্ট্রযন্ত্রনির্ভর দুঃশাসন কায়েম করেছিল। ভোটহীনতার দীর্ঘ ছায়া, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দমন-পীড়ন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট-সবকিছু একদম সীমায় এসে ঠেকেছিল।
আর ঠিক তখনই মাঠ পর্যায়ের সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য আর বসে থাকেননি। তারা বন্দুকের নল ঘুরিয়ে জনগণের পক্ষে দাঁড়াতে বাধ্য হন। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালীসহ দেশের বহু অঞ্চলে পুলিশের বর্বরতা রুখে দিতে সেনা অফিসাররা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন।
৩ আগস্টের দুপুরে শুরু হয় আসল খেলা:
সেদিন ঢাকার দক্ষিণাংশে এক শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশের অতর্কিত গুলিতে অন্তত ১৭ জন নিহত হন। তখনই সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে-কিন্তু পুলিশ ফায়ার করে সেনাদের ওপর। ব্যাস, এরপরই মাঠের মোড় ঘুরে যায়। সেনাবাহিনী বুঝে যায়, এ লড়াই দেশের বিরুদ্ধে নয়-দেশের পক্ষে, জনতার পক্ষে।
সেনারা চেপে ধরে ট্রিগার। পুলিশ-আওয়ামী সন্ত্রাসীরা হুঁশ ফিরে পায়। একের পর এক চেকপোস্ট ফাঁকা হয়, অস্ত্র ফেলা হয় রাস্তার পাশে। কেউ পালায়, কেউ আত্মসমর্পণ করে।
এটাই ছিল এক “People + Army vs Regime + Police” যুদ্ধ।
ফ্যাসিবাদের হৃদপিণ্ডে প্রথম গুলি
৩ আগস্ট দুপুরের ঘটনার পরই ভারতের নিয়ন্ত্রিত হাসিনা-ওয়াকার সিন্ডিকেটের পতনের শুরু হয়। হাসিনা গা ঢাকা দেয়, এবং পরবর্তী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ছদ্মবেশে দেশত্যাগ করে ভারতের পথে পালায়।
এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে আহতদের যখন প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হচ্ছিল, তখন গুলিবিদ্ধ আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের ভিআইপি চিকিৎসা চলছিল। হাসপাতালের করিডোরে পড়ে রইল বহু স্বাধীনতাকামী তরুণ, ছাত্র, নারী। তবুও কেউ থামেনি। যারা গুলি খেয়েছে, তারাই বলেছে-“আমরা ফিরে আসব, কিন্তু মাথা নোয়াব না।”
সেনাবাহিনীর দায় আর দিকনির্দেশনা
অনেকের মতে, সেনাবাহিনী যদি ১ জুলাই বিপ্লবের প্রথম দিন থেকেই রাষ্ট্রীয় নিরপেক্ষতার পরিবর্তে জনগণের পাশে দাঁড়াতো, তবে শত শত প্রাণ বাঁচত। কিন্তু প্রতিষ্ঠানগত টালমাটাল অবস্থান ও ভেতরের বিভাজন সেনাবাহিনীকে প্রথমদিকে নিরব দর্শক করে রেখেছিল। সময় যখন ফুরিয়ে যাচ্ছিল, তখনই কিছু সাহসী অফিসার ‘অভ্যন্তরীণ অভ্যুত্থান’ হিসেবে মানবতার পক্ষ বেছে নেন।
এই সাহসিকতা গোটা রাষ্ট্রকে নাড়িয়ে দেয়। মানুষ বুঝে যায়, সেনাবাহিনী যদি চায়, শাসকের নয়, দেশের পক্ষে কাজ করাই সম্ভব।
ইতিহাসের দায়: বিচারহীনতার অবসান চাই
এই দিনের অন্যতম ট্র্যাজেডি হলো-আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, ডাক্তার, হাসপাতাল কর্মী, পুলিশ ও রাষ্ট্রীয় ক্যাডাররা মিলে আহতদের চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করে, এমনকি ফাঁস করে দেয় আন্দোলনকারীদের অবস্থান। এর জন্যও প্রয়োজন একটি সর্বজনীন, স্বাধীন ও আন্তর্জাতিক তদন্ত। ৩ আগস্ট কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এক গণঅভ্যুত্থানের স্নায়ুকেন্দ্র।
ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করি:
আজ, ৩ আগস্ট ২০২৫, এক বছর পর ফিরে তাকালে দেখা যায়—এই দিনটাই ছিল সেই ঐতিহাসিক মোড়, যেদিন ভয়কে জয় করে জনগণ ও সেনাবাহিনী মিলে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। আজ যারা শহীদ, তারা কেবল রক্ত দিয়ে মাটি রাঙাননি, তারা ভবিষ্যতের জন্য বীজ বপন করে গেছেন।
তাই বলি-এই বাংলাদেশ আর কখনোই সেই আগের বাংলাদেশে ফিরবে না। ইতিহাস লেখা হয়ে গেছে রক্ত দিয়ে। এবং এই ইতিহাস কেউ মুছে ফেলতে পারবে না।
জয় হোক স্বাধীনতার। জয় হোক মানুষের। পতন হোক ভারতের দালালি ও স্বৈরতন্ত্রের।
লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক
নবজাগরণ।
বিপ্লবের সাক্ষী ও জুলাই যোদ্ধা আহত সাংবাদিক।
www.thenabajagaran.com
[বিপ্লবের মুখপত্র]