নোয়াখালীতে মা-সন্তান হত্যার দায় কার? শাস্তি কি যথেষ্ট?

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
“শুধু ভুল চিকিৎসা নয়, এটি একটি ঠাণ্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড। সাদা অ্যাপ্রোন পরে যারা এই অপরাধ করেছে, তারা পেশাদার খুনি নয় কি?”

২০২৩ সালের ১৬ অক্টোবর। নোয়াখালীর সাংবাদিক এম এ আউয়াল তার ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা মেয়ে উম্মে সালমা নিশিকে নিয়ে যান সাউথ বাংলা হাসপাতালে। বাবুর হৃৎস্পন্দন ছিলো ২৪১-অর্থাৎ, তাৎক্ষণিক ও জীবন-মরণ সংকটের ইঙ্গিত। অথচ সেদিন হাসপাতালের দুই চিকিৎসক-ডা. আক্তার হোসেন ও তার স্ত্রী ডা. ফৌজিয়া ফরিদ-রোগীকে বিনা পরীক্ষা ও বিনা অনুমতিতে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যান। মুহূর্তেই নিভে যায় দুটি জীবন-মা ও শিশু।

হ্যাঁ, আজ প্রায় দুই বছর পর বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) অবশেষে চিকিৎসকদের সনদ সাময়িকভাবে বাতিল করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে: এই ন্যায্য বিচার কেন এত দেরিতে? আর, এটি কি যথেষ্ট?

একটি ‘প্রাইভেট হাসপাতাল’ নামক হত্যাখানা?
সাউথ বাংলা হাসপাতাল-নামটা শুনলে বোঝা যায় আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন এক চিকিৎসালয়। কিন্তু বাস্তবে এটি এক ‘মরণ ফাঁদ’! এখানে চিকিৎসা হয় না, হয় পেশাগত গাফিলতি, অমানবিকতা ও অবহেলার প্রদর্শনী।

যে দেশে চিকিৎসক ও তার স্ত্রী মিলে রোগীর কোনরূপ পরীক্ষা ছাড়াই সিজার করতে পারেন, সেখানে স্বাস্থ্যব্যবস্থা আর কতোটা নীচে নামতে পারে?

প্রভাবশালীরা কী পার পেয়ে যাবে?
এই চিকিৎসকেরা শুধু সনদ হারিয়েছেন-তাও কয়েক বছরের জন্য। কিন্তু মেয়ের লাশ কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক অসহায় বাবার সামনে এই সাজা কতটা অর্থবহ?

সাংবাদিক এম এ আউয়ালের অভিযোগ স্পষ্ট:
“আমার অনুমতি ছাড়াই মেয়েকে সিজার করেছিল তারা। পরে মিথ্যে আইসিইউ নাটক করে মরদেহ পাঠায় কুমিল্লায়।”

কী ভয়াবহ সেই প্রতারণা! কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো-এই ভয়ঙ্কর অপরাধের পরও অভিযুক্ত চিকিৎসক ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ছিলেন দুধে ধোয়া তুলসীপাতা! একাত্তর টিভির সংবাদ না হলে হয়তো আজও বিচার হতো না।

সাংবাদিকের ন্যায়বিচারের আকুতি ও রাষ্ট্রের নীরবতা
উম্মে সালমার বাবা একজন সাংবাদিক। তিনি মৌখিক অভিযোগ করেছেন, লিখিত দিয়েছেন, পরে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। অথচ তাঁর পরিবারকে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি, হয়রানি ও প্রভাব খাটিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে।
একজন সাংবাদিক বাবার যদি এ হাল হয়, তাহলে সাধারণ নাগরিকদের কী দশা হয় তা সহজেই অনুমেয়।

আমরা কোন সমাজে বাস করছি?
এই ঘটনায় আমরা শুধু চিকিৎসকের পেশাগত ব্যর্থতা দেখি না-আমরা দেখি মানবতার মৃত্যু। আমরা দেখি একটি লোভী, দুর্নীতিপরায়ণ, প্রভাবশালী চক্র-যারা নিজেদের রক্ষা করতে পারে, কিন্তু গর্ভবতী নারী ও তার নবজাতকের জীবন রক্ষা করতে চায় না।

এটা কি ‘চিকিৎসা’?
না, এটা হচ্ছে “লাইসেন্সধারী হত্যাকাণ্ড”। বিএমডিসির সনদ বাতিল হয়তো একপ্রকার প্রশাসনিক স্বস্তি, কিন্তু এটি আদৌ ন্যায়বিচার নয়। এরা কারাগারে যায়নি। এদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয়নি। দুইটি জীবন শেষ করে তারা এখনো বেঁচে আছে-শুধু কিছুদিন ‘চিকিৎসা না করার’ নিষেধাজ্ঞায়!

আমরা কী করবো এখন?
১. এই মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা নিতে হবে রাষ্ট্রকে।
২. চিকিৎসা খাতে নতুন নজির স্থাপন করতে হবে-যাতে রোগীর সম্মতি ছাড়া অস্ত্রপচার করলেই সরাসরি ফৌজদারি অপরাধ ধরা হয়।
৩. প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর রেগুলেশন ও নিয়মিত অডিট চালু করতে হবে।
৪. সাংবাদিক এম এ আউয়ালের পরিবারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

নির্বিশেষে আমাদের করণীয় সাবধান সতর্কতা সচেতনতা বৃদ্ধি অপরিহার্য
আমরা রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি-কিন্তু এই রক্তভেজা স্বাধীন দেশে নিরাপদ চিকিৎসা আজও অলীক কল্পনা! এই নোয়াখালীর ঘটনা প্রতীকী এক কান্না-যে কান্না শুধু এক পিতা বা এক নবজাতকের নয়, বরং পুরো জাতির বিবেকের প্রতি এক ধাক্কা।

জেগে ওঠো, বাংলাদেশ। ন্যায়বিচার ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। মা-সন্তানের রক্তের ঋণ রাষ্ট্রকেই শোধ করতে হবে।

লেখক:সম্পাদক-
নবজাগরণ
বিস্তারিত জানতে পড়ুন :শেয়ার করুন সবাই
www.thenabajagaran.com