হুসাইনি ব্রাহ্মণ-কারবালার প্রান্তরে ধর্মের ঊর্ধ্বে এক বিস্ময়কর আত্মবলিদান

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:বিশেষ প্রতিবেদন-
ইতিহাস অনেক সময় আমাদের কাছে শুধু তারিখ, স্থান, ও পরিসংখ্যানের তথ্য হয় না—হয় রক্তের ঋণ, বিশ্বাসের শিকড়, আর মানবতার নীরব ডাক। সেই ডাক শুনেই, আজ থেকে প্রায় ১৩৪৫ বছর আগে, ইসলাম ধর্মের নবী মুহাম্মদের দৌহিত্র ইমাম হোসাইনের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন এক হিন্দু ব্রাহ্মণ—রিহাব সিধ দত। তার নামটি হয়তো আরব ইতিহাসের পাতায় নেই, কিন্তু উপমহাদেশের বহু মানুষ তার গল্প বুকের মাঝে ধারণ করে বেঁচে আছে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।

কারবালায় এক হিন্দু ব্রাহ্মণের আত্মদান!
৬৮০ খ্রিস্টাব্দ। কারবালার তপ্ত বালু, ইউফ্রেটিস নদীর তীরে দাঁড়িয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে জীবন দিলেন ইমাম হোসাইন ও তার সাথীরা। সেই সাথীদের মধ্যে ছিলেন রিহাব সিধ দত ও তাঁর সাত পুত্র—যারা সবাই যুদ্ধ করে শহীদ হন, জনশ্রুতি অনুযায়ী। এটি কেবল ধর্মীয় সহাবস্থান নয়—এ এক বিপ্লবী দৃঢ়তার বহিঃপ্রকাশ, যেখানে ধর্ম নয়, ন্যায়ের পক্ষে থাকা ছিলো মুখ্য।

হিন্দু হয়ে আশুরা পালন: হুসাইনি ব্রাহ্মণদের অনন্যতা:
রিহাব সিধ দতের বংশধররাই আজ পরিচিত ‘হুসাইনি ব্রাহ্মণ’ নামে। তাঁরা ধর্মান্তরিত হননি, হিন্দু থেকেছেন, কিন্তু ভালোবাসেন ইমাম হোসাইনকে, পালন করেন মহররম, করেন শোক, করেন মাতম। দিল্লি, পাঞ্জাব, কাশ্মীর, উত্তরপ্রদেশে তাদের বড় অংশ আজও আশুরার দিন রক্ত দিয়ে মাতম করেন, কাঁধে কালো কাপড় বেঁধে মিছিলে অংশ নেন, ইমাম হোসাইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।

এই অনন্য সম্প্রদায়ই প্রমাণ করে, ধর্মের নামে যুদ্ধ নয়—মানবতার নামে একত্র হওয়াটাই ইতিহাসের সত্য পথ।

‘বিষাদ সিন্ধু’ ও সাহিত্যের প্রতিফলন:
বাংলা সাহিত্যে এই ইতিহাস ছায়া ফেলেছে মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’-তে। যদিও রিহাব সিধ দতের নাম সেখানে নেই, তবুও কারবালার বেদনা, ত্যাগ, ও প্রতিরোধ বাংলার মানুষকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে শিখিয়েছে। এই সাহিত্যিক চেতনা আজও মানুষকে ইমাম হোসাইনের মহত্ত্বে একত্র করে।

এটা শুধু ইতিহাস নয়, এটা বিপ্লব!
যেখানে ইসলামিক কট্টরপন্থা অন্য ধর্মের অস্তিত্ব মেনে নিতে পারে না, সেখানে একদল হিন্দু ব্রাহ্মণ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলিম বিপ্লবীর স্মরণে মাতম করে যাচ্ছেন—এটা শুধু সহনশীলতা নয়, এটা সাম্প্রদায়িকতার গালে এক প্রচণ্ড চপেটাঘাত।

হুসাইনি ব্রাহ্মণদের অস্তিত্ব প্রমাণ করে, ধর্ম নয়, বিবেকই মানুষের আসল পরিচয়। শিয়া মুসলিমদের মতো তারাও মনে করেন, ইমাম হোসাইন ছিলেন মানবতার মুক্তির প্রতীক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের লড়াইয়ের চূড়ান্ত প্রতিমূর্তি।

আধুনিক সংকটকালে হুসাইনি চেতনার গুরুত্ব:
ভারতে মুসলিম-বিদ্বেষ আর বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ভেতরেও এই গল্প আমাদের শেখায়—একটি বিকল্প পথ সম্ভব। যে পথের নাম সহাবস্থান নয়, তার চেয়েও বেশি—সহমরণ, সহ-সংগ্রাম। আজকের দিনে, যখন ধর্মের নামে মানুষ খুন হচ্ছে, কারবালার হিন্দু শহীদের গল্প আমাদের শোনায় মুক্তির মন্ত্র—”মানবতার পক্ষে দাঁড়াও, ধর্মের নামে নয়, ন্যায়ের নামে জেগে উঠো।”

নবীর আদর্শ ও উনার বংশ কারো একার নয়?
ইমাম হোসাইন কারো একার নন। তিনি মানবতার।
আর সেই মানবতার জন্য আজও যদি হিন্দু ব্রাহ্মণরা চোখের জল ফেলেন, রক্ত দিয়ে মাতম করেন, তাহলে বুঝতে হবে, কারবালা কেবল একটি যুদ্ধ নয়—it was and still is a revolution of conscience.