জুলাই বিদ্রোহ: এই রাষ্ট্র কাঠামোকে আর বাহক নয়, ভাঙতেই হবে!

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
২০২৪ সালের জুলাই, বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ভয়ংকর অথচ গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। যে অধ্যায়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা ভেজা রক্তে, প্রতিটি বাক্য লেখা কান্না আর লড়াইয়ের অক্ষরে। এই মাসে জাতির বিবেক রাস্তায় নেমেছিলো – শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, মানবাধিকারের পক্ষে, একটি কল্যাণকর রাষ্ট্রব্যবস্থার স্বপ্নে।

সেই স্বপ্ন আজও অপূর্ণ।
এক শিশু ৩ আগস্ট যৌথ বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে প্ল্যাকার্ড তুলে ধরেছে – “শেখ হাসিনার পদত্যাগ চাই।” সে জানে না রাজনীতি, জানে না ক্ষমতার জটিল গাণিতিক খেলা, কিন্তু বুঝে ফেলেছে অন্যায়। সাহসিকতার এমন নিদর্শন ১৯৭১ সালের পর আর দেখা যায়নি। তার সঙ্গে মা দাঁড়িয়ে; পাশে কোনো ছাত্র, এক কোণে রিক্সাচালক, আরেক প্রান্তে বৃদ্ধ এক মুক্তিযোদ্ধা, এবং শত শত মানুষ, যারা কেউই কোনো দলের নয় – তারা কেবল দেশপ্রেমিক।

জুলাই বিপ্লব ছিলো ভিন্নধর্মী। এটি কোনো রাজনৈতিক দলের আখের গোছানোর আন্দোলন ছিলো না। এটি ছিলো রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপর সরাসরি আঘাত -যে রাষ্ট্র গুটিকয়েক দুর্বৃত্ত, গোষ্ঠী স্বার্থ আর ভারতীয় আগ্রাসনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিলো।

৪ আগস্ট, গণহত্যার সর্বোচ্চ পর্যায়! ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয় রক্তে। শুধু ঢাকায় নয়, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, সিলেট – প্রতিটি শহরে একেকটি রক্তাক্ত স্মারক। আপনি যদি সেদিন ঢাকায় থাকতেন, রাতে শুনতেন, একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স চলে যাচ্ছে লাশ নিয়ে – কারফিউর নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে। সাংবাদিক, ছাত্র, গৃহিণী, শিশুরাও রেহাই পায়নি।

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অভ্যন্তরে চলে চিকিৎসা বাছ-বিচার। গুলিবিদ্ধ কেউ চিকিৎসা পাবে কি না তা নির্ধারণ করে তার রাজনৈতিক পরিচয়। আমি নিজে আহত হয়ে হাসপাতালে গেলে দেখেছি-শিক্ষার্থীরা ফ্লোরে পড়ে আছে, কেউ কেউ রক্তে গড়াগড়ি খাচ্ছে, কিন্তু চিকিৎসা পাচ্ছে না। গুলি খেয়েও চিকিৎসার জন্য শত্রু বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ না হতে হয়! এ কেমন রাষ্ট্র?

আমার প্রিয় সাংবাদিক ভাই মুজাহিদুল ইসলাম – যিনি যাত্রাবাড়ীতে ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হন – তাকে দেখতে চাইলে জানতে পারি, তিনি গা ঢাকা দিয়েছেন। পুলিশ গ্রেফতার করতে খুঁজে বেড়াচ্ছে। রাষ্ট্র তখন যেন মানুষের সেবায় নয়, মানুষের শত্রু হয়ে উঠেছে।

এই রাষ্ট্রব্যবস্থা, এই শাসনতন্ত্র, এই ক্ষমতার দম্ভ – সবকিছুই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা কি ১৯৭১ সালে এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? একজন মানুষের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে গণহত্যায় ব্যবহার করা হবে? বিচারবহির্ভূত হত্যাকে ন্যায্যতা দেওয়া হবে?

জুলাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে-কেবল সরকার পরিবর্তন নয়, রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোগত রূপান্তর প্রয়োজন। দুর্নীতিমুক্ত, জনগণের মালিকানাধীন, বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসন ও মানবিক বিচারব্যবস্থার একটি নতুন বাংলাদেশ গঠনের জন্য এখনই সময়। আর এক মুহূর্ত দেরি নয়।

আমরা ভুলবো না সাহসী সেই শিশুদের, সাংবাদিকদের, শ্রমজীবী মানুষদের, যারা এ রাষ্ট্রের অসৎ চেহারা উন্মোচন করেছে নিজেদের রক্ত দিয়ে।
আমরা ভুলবো না মুজাহিদুল, তামান্না, তোহা, কিংবা অসংখ্য নামহীন শহীদদের।
আমরা শ্রদ্ধা জানাই সেই গোপন ক্যামেরার পেছনে থাকা আলোকচিত্রীকেও, যার ছবি ইতিহাস হয়ে উঠেছে।

আজ ২০২৫ সালের জুলাইয়ে দাঁড়িয়ে বলি-
আমরা ভুলিনি। ভুলবো না। এবং আমরা ক্ষমাও করবো না।
জয় হোক মানুষের, জয় হোক নতুন রাষ্ট্রের।

লেখক: সম্পাদক –
নবজাগরণ।
জুলাই যোদ্ধা -আহত সাংবাদিক।

বিস্তারিত জানতে পড়ুন:
www.thenabajagaran.com