হলুদ সাংবাদিকতা: বিকৃতি নাকি বিপ্লব? পুলিৎজার থেকে হের্স্ট, সত্য থেকে সস্তায় উত্তরণের ইতিহাস

নবজাগরণ- বিশেষ প্রতিবেদন:
৪ জুলাই ২০২৫

“Yellow Journalism”-আজকের দিনে এটি যেন একটি নোংরা শব্দ। যেন নৈতিকতা-বিবর্জিত সংবাদ পরিবেশনের ছদ্মনাম। কিন্তু ইতিহাস কি এত সরল? ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ বলতে আমরা যা বুঝি, তা কি আদতেই সাংবাদিকতার অধঃপতনের চিহ্ন, নাকি তা ছিল সমাজ-সংস্কারের এক বিপ্লবী রূপ?

পেছনের কাহিনি: পুলিৎজার যেখানে শুরু, সেখানেই ইতিহাস
১৮৮৩ সাল। আমেরিকার নিউ ইয়র্কে একজন অভিবাসী সাংবাদিক জোসেফ পুলিৎজার ‘নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড’ নামক এক পত্রিকা হাতে নেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সাহসী: সংবাদপত্রকে গণমানুষের মুখপত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা, এবং সেটিকে রাষ্ট্র ও শাসকের জবাবদিহির জন্য ব্যবহৃত করা।

তৎকালীন মার্কিন সংবাদপত্রের জগৎ ছিল অভিজাত, শুষ্ক এবং উচ্চশ্রেণির পাঠকের জন্য। পুলিৎজার সেই ব্যারিকেড ভাঙলেন:

রবিবারের রঙিন সংখ্যা
শিশুদের জন্য কার্টুন সিরিজ
যুদ্ধ ও রোমাঞ্চকর গল্প
কুইজ প্রতিযোগিতা
সমাজ সংস্কারমূলক প্রতিবেদন

এই পত্রিকার এক অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল-‘হোগান’স এলি’ নামক কার্টুন সিরিজে ‘হলুদ বাচ্চা’ (Yellow Kid) নামের একটি জনপ্রিয় চরিত্র, যা পাঠকের মনে বিপুল দাগ কাটে। এর কারণেই পরবর্তীতে ‘Yellow Journalism’ শব্দবন্ধটির জন্ম হয়।
প্রতিদ্বন্দ্বিতার নামে প্রতিহিংসা: হের্স্ট বনাম পুলিৎজার

পুলিৎজারের ঈর্ষণীয় সাফল্য চোখে পড়ে আরেক প্রভাবশালী উদ্যোক্তা উইলিয়াম র‍্যান্ডলফ হের্স্টের, যিনি ‘নিউ ইয়র্ক জার্নাল’ কিনে নিজেই নেমে পড়েন বাজারে আধিপত্য বিস্তারের যুদ্ধে।

হের্স্ট:
পুলিৎজারের প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট আর.এফ. আউটকোল্টকে মোটা অর্থে কিনে নেন
হোগানের এলির দ্বিতীয় হলুদ বাচ্চা তৈরি করেন
বড় বড় ভিত্তিহীন শিরোনাম, নাটকীয় সাক্ষাৎকার, মিথ্যা-বানোয়াট সংবাদ প্রচার শুরু করেন

সাংবাদিকতায় বিক্রয়মূল্যকে সত্যের চেয়ে অগ্রাধিকার দেন
এখানেই শুরু হয় সাংবাদিকতার অন্যতম বিতর্কিত অধ্যায়-হলুদ সাংবাদিকতা।
“হলুদ যুদ্ধ”: কিউবা সংকট ও সংবাদপত্রের উত্তেজনাপূর্ণ আগুন

১৮৯৮ সালে আমেরিকা-স্পেন যুদ্ধ ছিল মূলত একটি সামরিক সংঘাত। কিন্তু ঐ যুদ্ধের জন্য মাটি তৈরি করেছিল নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড ও নিউ ইয়র্ক জার্নালের মতো পত্রিকাগুলোর ‘হলুদ প্রেস’।
তারা বলেছিল-

“নারী কয়েদী নির্যাতনের শিকার”
“শিশুরাও যুদ্ধে যাচ্ছে”
“স্পেনিশ বাহিনীর বর্বরতা সীমা ছাড়িয়েছে”
এসব গল্প, যদিও অনেকটাই ভিত্তিহীন ছিল, মার্কিন জনগণের মধ্যে যুদ্ধ চেতনা উস্কে দেয়। একেই অনেকে বলেছেন:

“The first media-manufactured war in history”

এজন্য এই যুদ্ধ ইতিহাসে পরিচিত হয়ে ওঠে-“Yellow Media War” নামে।

সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্ব: হলুদ সাংবাদিকতা কি কেবল ‘মন্দ’?
আজকের দৃষ্টিকোণ থেকে ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ মানে মিথ্যা, অর্ধসত্য, অপপ্রচার, অতিনাটকীয়তা-তবে ইতিহাস বলছে, একে একতরফা ‘নেতিবাচক’ বলে উড়িয়ে দেওয়া ঠিক নয়।

হলুদের দুই রূপ ছিল:
১. মূলধারার হলুদ- যা মানুষকে তথ্য জানায়, আগ্রহী করে, সংবেদনশীল করে। সমাজ-সংস্কারের কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল (যেমন পুলিৎজারের কাগজ)।

২. নকল হলুদ বা বিকৃত হলুদ – যা শুধুমাত্র বিক্রয়ের লক্ষ্যেই তৈরি, যেখানে সত্যের কোনো দায়বদ্ধতা নেই (যেমন হের্স্টের কাগজ)।

এই দ্বন্দ্বের মাঝে দাঁড়িয়েই ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ একদিকে পাঠকের জনপ্রিয়তা পায়, অন্যদিকে গঠনতন্ত্রে ‘গোপনীয়তা ও নৈতিক সীমা রক্ষার আন্দোলন’-ও গড়ে তোলে।

আইন, নৈতিকতা ও জবাবদিহি: স্যামুয়েল ওয়ারেন ও লুই ব্র্যান্ডেইস-এর বিপ্লব

১৮৯০ সালে দুই আইনজীবী স্যামুয়েল ওয়ারেন ও লুই ব্র্যান্ডেইস তাঁদের বিখ্যাত প্রবন্ধ “The Right to Privacy” প্রকাশ করেন।
তারা বলেন:

“সংবাদপত্রের অসীম স্বাধীনতা ব্যক্তি গোপনীয়তার বিরুদ্ধে অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
এই প্রবন্ধ গণমাধ্যমের জন্য আইনগত ও নৈতিক কাঠামো নির্মাণের পথ তৈরি করে, যা পরবর্তীতে বহু রাষ্ট্রে গণমাধ্যম-সংক্রান্ত নীতিমালার ভিত্তি হয়ে ওঠে।

আজকের বাংলাদেশে হলুদ সাংবাদিকতা: কি শিখলাম আমরা?
আজকের বাংলাদেশেও হলুদ সাংবাদিকতার নাম শুনলেই অনেকের মন বিষিয়ে ওঠে। অথচ, ইতিহাস বলে:

সত্য ও শক্তির লড়াইয়ে সাংবাদিকতাই প্রধান অস্ত্র
সংবেদনশীলতা মানেই মিথ্যা নয়, বরং সাহসী হওয়ার প্রমাণ
হলুদ সাংবাদিকতা মানেই ‘খারাপ সাংবাদিকতা’ নয়, বরং তার প্রেক্ষাপট জানতে হবে
“পাঠকের চেতনা জাগানোই সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্য-আর সে চেতনার রং সবসময় সাদা-কালো হয় না, মাঝে মাঝে হয় হলুদও।”

হলুদ সাংবাদিকতা-আলো নাকি অন্ধকার?
হলুদ সাংবাদিকতা ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত সাংবাদিক ঘরানাগুলোর একটি। এটা আমাদের শেখায়-
কিভাবে সংবাদ মাধ্যম রাষ্ট্র নির্মাণে ভূমিকা রাখে

কিভাবে জনপ্রিয়তা ও নৈতিকতা সংঘর্ষে পড়ে
কিভাবে নতুন আইন, দায়িত্ব ও সংবেদনশীলতার জন্ম দেয়
তাই, যারা আজকের দিনে হলুদ সাংবাদিকতাকে কেবল ধ্বংসাত্মক মনে করেন, তারা হয়তো ইতিহাসের প্রথম পাতাগুলো পড়েননি।

ট্যাগস: জোসেফ পুলিৎজার, উইলিয়াম হের্স্ট, হলুদ সাংবাদিকতা, নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড, সাংবাদিকতার ইতিহাস, হলুদ প্রেস, আমেরিকা-স্পেন যুদ্ধ, ব্র্যান্ডেইস, পত্রিকা নীতি, গোপনীয়তা অধিকার।