মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
“রাজনীতিতে আবেগের কোনো স্থান নেই”-এই কথা বলেছেন সালাহউদ্দিন আহমেদ।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে-তাহলে কি ১৯৭১ সালে মায়ের মুখ মনে করে কাঁদতে কাঁদতে রণাঙ্গনে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধার আবেগ ছিল ভুল?
তাহলে কি ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানে সেলিম-দেলোয়ারের আত্মদানের পেছনে কোনো গণচেতনার ঝাঁঝ ছিল না?
না, আপনি যদি বলেন “সেগুলো আবেগ ছিল না”, তাহলে আপনাকে বলতে হবে: আবেগ আর রাজনৈতিক চেতনার মধ্যে বিভাজন তৈরির এই চেষ্টা আসলে ইতিহাসবিমুখ এক মিথ্যাচার।
আবেগই তো বিদ্রোহের আগুনে জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করেছে স্বৈরাচার
২০২৪ সালের জুলাইয়ে বাংলার রাস্তায় যেসব খালি হাতে তরুণ বুক চিতিয়ে সরকারের গুলি আর পুলিশি সন্ত্রাসের সামনে দাঁড়িয়েছিল, তাদের কী ছিল?
না কোনো দল, না কোনো নেতার ছায়া, ছিল শুধু আত্মমর্যাদার তীব্র স্পর্ধা আর ন্যায়ের জন্য এক অদম্য আবেগ।
এই আবেগের নাম-বিদ্রোহ।
এই আবেগের নাম-জাতি গড়ার অধিকার।
এই আবেগের নাম-স্বাধীনতার পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধ।
তাদের এই আত্মত্যাগ যদি “আইনি গুরুত্বহীন” হয়, তাহলে ৭১ সালের রক্ত, ৯০ সালের অভ্যুত্থান, ৬৯ সালের ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান-সবই কি আবেগের অপচয় ছিল?
না, তা নয়।
জুলাই সনদ: ইতিহাসের দাবি, সময়ের প্রয়োজন-আগামী প্রজম্মের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত
জুলাই সনদ কোনো দলীয় চুক্তি নয়।
এটা এক মহান রক্তস্নাত ঐতিহাসিক দাবি-যেখানে বলা হয়েছে,
অন্তর্বর্তীকালীন নিরপেক্ষ জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা খর্ব করে সংসদীয় কাঠামো ফিরিয়ে আনতে হবে
নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার এবং বাহিনীকে জবাবদিহির কাঠামোতে আনতে হবে
এবং শহীদ ও আন্দোলনকারীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে হবে
এই সনদ মানে শুধু চার পাতার কাগজ নয়, এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যতের রূপরেখা।
সংবিধান তো জনতারই দলিল, সেনাবাহিনীর নয়
যাঁরা বলেন “জুলাই সনদের কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই”-তাঁদের জিজ্ঞাসা করতে হয়:
সাংবিধানিক ভিত্তি কারা দেয়? জনগণ না সেনা ব্যারাক?
১৯৭২ সালের সংবিধানও তো এসেছে রক্তাক্ত যুদ্ধের মাধ্যমে, কারও আদালত বা সংবিধান কমিশনের নয়।
তাহলে আজ ২০২৪ সালের এই বিপ্লব, যেখানে হাজার হাজার তরুণ শহীদ হয়েছেন, প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছে সব জেলা-তাদের রক্ত কি সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাওয়ার অযোগ্য?
এ কেমন গণতন্ত্র, যেখানে শহীদের রক্তের চাইতে রাজনীতিবিদের সুবিধা বড়?
শহীদদের রক্তের স্বীকৃতি না দিলে রাষ্ট্র হবে বিশ্বাসঘাতক
বাংলাদেশের ইতিহাসে যারা প্রতিবার শহীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে ক্ষমতায় গেছেন, আজ আবারো সেই চিরচেনা দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি দেখছি।
আন্দোলনের সময় মুখ বন্ধ, শহীদের লাশ কাঁধে নেয়নি কেউ, এখন আন্দোলনের ফলভোগ করতে করতে বলছেন-“এটা আবেগ”।
না, এটা শুধু রাজনৈতিক সুবিধাবাদ নয়, এটা জাতির সঙ্গে প্রতারণা।
আজ যদি জুলাই বিপ্লবকে সংবিধানে জায়গা না দেওয়া হয়, তাহলে একে একে আমরা হারাবো আমাদের আত্মপরিচয়।
শহীদদের অপমান মানে ৭১-এর অপমান।
২৪-এর শহীদদের মর্যাদা না দেওয়া মানে, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রকেই অসম্মান করা।
যারা স্বীকৃতির বিরোধিতা করছে, তারা কার পক্ষে?
এই প্রশ্ন আজ উঠতে বাধ্য-যারা জুলাই সনদের স্বীকৃতির বিরোধিতা করছে, তারা কি বাংলাদেশের স্বার্থে?
নাকি ভারতের স্বার্থে?
নাকি সামরিক-আমলাতন্ত্রের ‘Deep State’-এর কাছে আত্মসমর্পণকারী?
জুলাই বিপ্লব ছিল এক জনতার প্রতিরোধ যুদ্ধ-ভারতের আধিপত্য, চীনের নীরব চাপ, সেনাবাহিনীর ছায়া, এবং আমলাতন্ত্রের দমননীতির বিরুদ্ধে।
আজ যদি এই বিপ্লবকে স্বীকৃতি না দেওয়া হয়, তাহলে রাষ্ট্রের চরিত্র কখনও বদলাবে না।
এ রাষ্ট্র রয়ে যাবে লুটেরাদের হাতে, শহীদদের নয়।
বিপ্লবীদের দাবি:
১. জুলাই সনদকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে
২. ২৪-এর শহীদদের রাষ্ট্রীয়ভাবে গণশহীদ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে
৩. বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের তদন্তে জাতীয় ট্রুথ কমিশন গঠন করতে হবে
৪. অন্তর্বর্তী সরকার কাঠামো নিয়ে গণশুনানি করতে হবে জাতীয় পর্যায়ে
৫. নির্বাচনী ব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কার ও রাজনৈতিক দলগুলোর দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে
আবেগ ছাড়া বিপ্লব সফল করা অসম্ভব!
জুলাই শুধুই আবেগ নয়।
এই আবেগেই লুকিয়ে আছে আমাদের জাতীয় মুক্তির দিশা।
এই আবেগের নাম সাহস।
এই সাহসই আগামী প্রজন্মের জন্য একটা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ তৈরি করতে পারে।
কাজেই, যারা আজ শহীদের রক্তকে ‘আবেগ’ বলে উড়িয়ে দিতে চায়-তাদের মুখোশ উন্মোচন করো।
এই রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, সালাহউদ্দিনরা নয়।
জুলাই শহীদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দাও।
বাঙালির ইতিহাসকে বিকৃত করো না।
লেখক:সম্পাদক
নবজাগরণ
জনগণের পক্ষের কণ্ঠস্বর