মো:আবু তাহের পাটোয়ারী :
“তোমরা আমাকে বলেছিলে, হাফেজ হয়ে মরদেহ গোসল দিয়ে সংসার চলবে না। আজ আমি এক হাফেজ হয়েই গোটা রাষ্ট্র চালাচ্ছি।” এ কথার মধ্যেই যেন নিহিত রয়েছে রজব তাইয়্যেব এরদোয়ানের জীবনের সারকথা।
একটি সময় ছিল, যখন তুরস্কে মসজিদে আজান দেওয়া নিষিদ্ধ ছিল। হিজাব ছিল অপরাধ। ইসলামী কবিতা লেখার অপরাধে কারাবরণ করতে হতো। যে রাষ্ট্রে মাত্র কয়েক দশক আগে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানেই ‘সন্দেহজনক দৃষ্টিভঙ্গি’, সেই রাষ্ট্রে আজ হাজার হাজার মাদ্রাসা, লাখো হাফেজ, এবং এক কুরআনপাঠ করা প্রেসিডেন্ট।
🛑 আতাতুর্কের ছায়া থেকে বেরিয়ে ইসলামি পুনর্জাগরণ
কামাল আতাতুর্কের প্রতিষ্ঠিত কট্টর সেক্যুলার সংবিধান তুরস্ককে দীর্ঘদিন ধর্মশূন্য এক রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। ইসলাম ছিল রাষ্ট্রের প্রান্তে ঠেলাধরা এক সংখ্যালঘু চেতনা মাত্র। সেই সময়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এক তরুণ এরদোয়ান ছোট্ট একটি কবিতা লেখার অপরাধে জেলে গিয়েছিলেন। তাঁর মেয়েকে স্কুলের অনুষ্ঠানে হিজাব পরে ঢুকতে দেয়নি প্রশাসন।
তাঁকে বারবার আতাতুর্কের সংবিধানে ‘অনুগত্যের নাটক’ করতে হয়েছে।
কিন্তু ভিতরে ভিতরে তিনি প্রস্তুত করেছেন এক বিপ্লব-শিক্ষার ভিতর দিয়ে, সংস্কৃতির ভিতর দিয়ে, সামাজিক আচরণ বদলের মধ্য দিয়ে।
🕌 ইসলামের ঘরে ফেরা: ১৭ বছরের বিপ্লব
২০০২ সালে ক্ষমতায় এসে এরদোয়ান শিক্ষা ব্যবস্থাকে রূপান্তরিত করেন।
🔹 যেখানে আগে মাত্র ৪৫০টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ছিল, ২০১৮ সালের মধ্যে তা দাঁড়ায় ৪৫০০–তে।
🔹 ২০১২ সালের তুলনায় ইমাম হাতিপ স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে যায় ৫ গুণ।
🔹 ধর্মীয় পাঠ্যক্রমকে গুরুত্ব দিয়ে কুরআন, হাদিস, ইসলামী মূল্যবোধ শেখানো বাধ্যতামূলক করা হয়।
🔹 শিশুরা যাতে নামাজের সাথে মসজিদকে ভালোবাসতে শেখে-সেই লক্ষ্যেই চালু হয় “ফজরের জামাতে অংশ নিলে সাইকেল উপহার” কর্মসূচি।
এমনকি পশ্চিমা মূল্যবোধের প্রতীক ডারউইনের বিবর্তনবাদও পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হয়। যেন ধর্মবিরোধী চিন্তার ফাঁক গলে নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত না হয়।
আজান বনাম গান: ধর্ম-সেক্যুলার দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ
ইজমিরে মসজিদের মাইক দিয়ে আজানের বদলে গান বাজিয়ে চরম ধৃষ্টতা দেখায় সেক্যুলার যুবকরা। প্রতিক্রিয়ায় হাজারো মানুষ ছাদে দাঁড়িয়ে সম্মিলিত কণ্ঠে আজান দেয়। এর প্রতিধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে পুরো তুরস্কে। এই ঘটনা প্রমাণ করে, এরদোয়ানের ‘ধার্মিক প্রজন্ম গড়ার কৌশল’ আজ ফলপ্রসূ।
“শরীয়াহ কোথায়?”-এক মূর্খ উস্কানির জবাব
সমালোচকরা বলেন, “তুরস্কে শরীয়াহ চালু হয়নি”, “ন্যাটো ত্যাগ করেনি”, “ইসরায়েলকে ধ্বংস করছে না”। তারা বোঝে না, এটি এক কৌশলের যুদ্ধ। আজকের তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যের নিছক আবেগী খেলোয়াড় নয়, বরং আধুনিক প্রযুক্তিতে সজ্জিত, কৌশলী এক ইসলামী রাষ্ট্রের প্রতিচ্ছবি।
তুরস্ক আজ ড্রোনে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ শক্তি।
তারা চিকিৎসা সহায়তায় বিশ্বে মানবিক দৃষ্টান্ত তৈরি করছে।
তারা ‘পলিটিক্যাল ইসলাম’–এর ব্যর্থতাকে ‘স্ট্র্যাটেজিক ইসলাম’-এর মাধ্যমে নতুন প্রাণ দিয়েছে।
সমালোচনা নয়, প্রয়োজন ঐক্যের ও দোয়ার
আমরা তালেবানের সামরিক বিজয়ে যেমন উচ্ছ্বসিত হই, ঠিক তেমনি রাজনৈতিক কৌশলে এগিয়ে যাওয়া এরদোয়ানের তুরস্ক আমাদের আশাবাদের দীপ্ত প্রতীক হওয়া উচিত।
সমালোচনা নয়, প্রয়োজন ভবিষ্যতের মুসলিম রাষ্ট্রনীতি গঠনে এরদোয়ানের মডেলকে অনুসন্ধান করা- শিক্ষায়, প্রযুক্তিতে, সংস্কৃতিতে এবং সবচেয়ে বড় করে চেতনায়।
পুনশ্চ:
এক হাফেজ, যার চাচা বলেছিল “মরা মানুষের গোসল দিয়ে সংসার চলবে না”, আজ সেই হাফেজ তুরস্ক নামক জাতিকে মোরা ভাবনার অজেয় শৃঙ্গ–এ দাঁড় করিয়েছেন।
আমরা কেবল বলি-“ইয়া আল্লাহ, তুমি এরদোয়ানকে হেফাজত করো, তাঁর কৌশলকে বরকত দাও।”
✦ তথ্যসূত্র:
📰 Reuters Investigative Report
📰 New York Times Special Coverage
📊 তুরস্কের জাতীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান
📌 ইজমির আজান প্রতিবাদের লাইভ ভিডিও সংকলন
লেখক:মো:আবু তাহের পাটোয়ারী; সম্পাদক-নবজাগরণ-তথ্যনির্ভর,চেতনায় দৃঢ়।