ত্রিভুজ আতঙ্ক নাকি ভূরাজনীতির দেউলিয়াপনা? ভারতের সেনাপ্রধানের ‘বাংলাদেশ-চীন-পাকিস্তান’ ভীতি এবং উপনিবেশবাদী মনস্তত্ত্বের নগ্ন উন্মোচন

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল অনিল চৌহান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে যে মন্তব্য করেছেন-যেখানে তিনি বাংলাদেশকে চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে মিলিয়ে”ত্রিপক্ষীয় হুমকি”র আশঙ্কা প্রকাশ করেন-তা নিছক এক সামরিক প্রতিক্রিয়া নয়। বরং এটি ভারতের কূটনৈতিক অহমিকা ও উপনিবেশবাদী মানসিকতার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।

এই বক্তব্য কেবল কৌশলগত সতর্কবার্তা নয়, এটি এক ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ অগ্রহণযোগ্য বার্তা: যেন বাংলাদেশ নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনায় স্বাধীন নয়, এবং যেন ভারতীয় অনুমোদন ছাড়া আমাদের কোনো সম্পর্ক বা অংশীদারিত্ব গড়া উচিত নয়।

❝ বাংলাদেশ একটি উপনিবেশ নয় ❞
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র। চীন বা পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কেমন হবে-তা নির্ধারণ করার অধিকার বাংলাদেশের রয়েছে, দিল্লির নয়। ভারত যদি যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল কিংবা QUAD জোটের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্ব করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ কেন চীন বা অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে অবকাঠামো, বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা বা প্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা করতে পারবে না?

ভারতের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার এই বক্তব্য সরাসরি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপের শামিল। এটি কূটনৈতিক শিষ্টাচার তো নয়ই, বরং এক ধরনের ‘নতুন যুগের করদ রাজ্য’ নীতি।

তথ্যভিত্তিক ভারতের বহুমুখী বাংলাদেশবিরোধী আগ্রাসন?
ভারতের বাংলাদেশবিরোধী ভূরাজনীতির বাস্তবতা এই বক্তব্যে নতুন কিছু নয়। বরং এটি বহুদিনের একটি পরিকল্পিত বহুরুপী দখল ও নিয়ন্ত্রণের নীলনকশা-র অংশ। উদাহরণ হিসেবে নিচের বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে দাঁড়ায়:

পানি আগ্রাসন:
ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবাহিত ৫৪টি নদীর ওপর একতরফাভাবে বাঁধ ও পানি প্রত্যাহার করেছে। তিস্তা চুক্তি একযুগ ধরে ঝুলে আছে। বরং নতুন করে গোমতী; মনু, ধরলা ও আত্রাই নিয়েও একতরফা নিয়ন্ত্রণ শুরু করেছে-যা বাংলাদেশের কৃষি, জীববৈচিত্র্য ও জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

উন্নয়ন ও অবকাঠামোতে বাধা:
বাংলাদেশ যখন চীনের সহায়তায় পদ্মা সেতু, পায়রা বন্দর বা বঙ্গবন্ধু টানেলের মতো মেগা প্রকল্প চালু করে-ভারতের মিডিয়া ও রাজনৈতিক মহল তখন থেকেই “চীন-হুমকি” বা “ঋণের ফাঁদ” বলে অপপ্রচার চালায়। অথচ এই সব প্রকল্পে ভারত কখনও নিজে অংশ নিতে চায়নি।

মিডিয়া আগ্রাসন ও সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার:
বাংলাদেশে ভারতীয় বিনোদন, সংবাদ ও সামাজিক মিডিয়ার একচ্ছত্র প্রভাব তৈরি করে রাখা হয়েছে-যার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের মনন ও সংস্কৃতিতে কৌশলগত প্রভাব বিস্তার করা হয়। মিডিয়া-যুদ্ধে বাংলাদেশকে একটি ভীরু, নির্ভরশীল জাতি হিসেবে চিত্রিত করার অপচেষ্টা ক্রমাগত চালানো হয়।

রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও পছন্দের সরকার:
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ‘পছন্দের দল’ ও ‘নমনীয় সরকার’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে চায় দিল্লি। বিভিন্ন সময় বিরোধী দলকে “ভারতবিরোধী” আখ্যা দিয়ে জনগণের মধ্যেও বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়।

নিরাপত্তা বাহিনী ও সীমান্ত দমননীতি:
বিএসএফ দ্বারা প্রতিবছর গড়ে ৫০ জন বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করা হয়, যাদের অনেকে চোরাকারবারি নয়-সাধারণ কৃষক বা দিনমজুর। এইসব হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয় না, বরং “সীমান্ত নিরাপত্তা”র নামে বৈধতা দেয়া হয়।

চীনের উত্থান নয়, ভারতের অহংকারে ভাঙন!
ভারতের প্রকৃত ভয় চীনের উত্থান নয়, বরং প্রতিবেশীদের স্বাধীনতা ও বিকল্প পথ বেছে নেয়ার সক্ষমতা। বাংলাদেশ যদি নিজস্ব স্বার্থে নতুন জোট, অবকাঠামো বা নিরাপত্তা অংশীদার খোঁজে, সেটি ভারতের অহংকারে আঘাত হানে। ভারত চায় তার আশপাশে কেবল ‘নমনীয় রাষ্ট্র’ থাকুক, ‘স্বাবলম্বী বন্ধু’ নয়।

প্রতিবেশীদের বন্ধু না পুলিশ?
মিয়ানমারে সামরিক হস্তক্ষেপ, নেপালের ভূখণ্ড দখল, ভুটানের ওপর চীনা হুমকির ছুতোয় অনুপ্রবেশ, শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ চেষ্টার মতো ঘটনায় প্রমাণ মেলে-ভারত এখন “বন্ধু রাষ্ট্র” নয়, বরং “আঞ্চলিক প্রভু” হওয়ার লক্ষ্যে এগোচ্ছে।

আমাদের জবাব একটাই:
“বাংলাদেশ বন্ধু চায়, প্রভু নয়। সহযোগিতা চায়, অনুমতি নয়। স্বাধীনতা চায়, শর্ত নয়।”
আমরা কারও করুণা চাই না, মাথা নত করে চলি না। আমরা চাই একটিমাত্র জিনিস-নিজের পতাকাতলে মাথা উঁচু করে চলার অধিকার।

লেখক: সম্পাদক
-নবজাগরণ।
বিস্তারিত পড়ুন | শেয়ার করুন | সচেতনতা ছড়ান:
🌐 www.thenabajagaran.com
#ভারতবাংলাদেশ #সার্বভৌমত্ব #ত্রিপাক্ষিকসম্পর্ক #আধিপত্যবাদ #Nabojagoron #BangladeshChinaPakistan #IndianArmy #Geopolitics #বাংলাদেশচায়স্বাধীনতা