সীমান্তে অস্থিরতা ও উত্তেজনা পরশুরামে বেড়িবাঁধ নির্মাণে ফের বাঁধা বিএসএফ

ফেনী সংবাদদাতা :
ফেনীর পরশুরামের নিজকালিকাপুর সীমান্তে মুহুরী নদী সংলগ্ন বল্লারমুখার বেড়িবাঁধ পুনর্নির্মাণে বাধা দিয়েছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। বিএসএফ বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজ বন্ধ রাখতে বললেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদারের লোকদের সঙ্গে বাঁধ পুনর্নির্মাণে অংশ নিয়ে কাজ চালু রেখেছেন স্থানীয়রা।এনিয়ে সীমান্তে দেখা দিয়েছে উত্তেজনা। গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারী) সকালে ভারতের ঈশানচন্দ্র নগর ও বাংলাদেশের নিজ কালিকাপুর ক্যাম্পের বিজিবি-বিএসএফ’র মধ্যে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।

জানা গেছে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে দেশের অভ্যন্তরে ভারী বৃষ্টিপাত ও ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে ফেনী জেলার পরশুরাম, ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর ও ফুলগাজী উপজেলার বেশির ভাগ এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। স্মরণকালের ওই বন্যায় জেলার কয়েক লাখ মানুষ ঘরবাড়ি, ফসল ও সম্পদ হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয় । বন্যায় মুহুরী কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর ১০২টি স্থানের বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। পানির তোঁড়ে মুহুরী নদীর তীরবর্তী পরশুরামের নিজ কালিকাপুর সীমান্তের বল্লারমুখা বেড়িবাঁধের তিনটি স্থানে প্রায় ৩শ মিটার বেড়িবাঁধ ভাঙন সৃষ্টি হয়। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর থেকে এখানের বাঁধ পুনর্নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছিল এলাকাবাসী।২০২৪ সালের বর্ষা মৌসুমে পাহাড়ি ঢলের চাপে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিলোনিয়া শহর প্লাবিত হয়। পরে বল্লামুখা খালের মুখে ভারতীয় অংশে বিএসএফের সদস্যদের সহযোগিতায় বাঁধ কেটে দেয় ভারতীয়রা। এতে সিলোনিয়া নদীর পানি বেড়ে বহু গ্রাম প্লাবিত হয়। একপর্যায়ে বাংলাদেশ অংশে বাঁধটি কেটে দিতে জোর চেষ্টা করলেও বিজিবি ও স্থানীয়দের বাধার মুখে তা ব্যর্থ হয়েছে।
‘গত ২০ আগস্ট সকালে বিভিন্ন মসজিদে মাইকিং করে বল্লামুখার খালের বাঁধের ব্যাপারে গ্রামবাসীদের সতর্ক থাকতে বলা হয়। ওইদিন রাত ৮টার দিকে বাংলাদেশ অংশের বাঁধ কাটতে চেষ্টা করে বিএসএফ। তাদের সহযোগিতায় ভারতীয় নাগরিকরাও এগিয়ে আসেন। বাঁধে অবস্থান নেয়া বাংলাদেশি বাসিন্দাদের ছত্রভঙ্গ করতে বিএসএফ পাঁচ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোঁড়েন। পরে গ্রামবাসীদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে নিজ কালিকাপুর বিজিবি ক্যাম্পের সদস্যরা। তাদের বাধার মুখে খালের বাঁধটি কাটতে পারেননি ভারতীয়রা। এতে বন্যায় আরও বেশি দুর্ভোগের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে মির্জানগর ইউনিয়নসহ পরশুরামের নিম্নাঞ্চল।’

এদিকে আগামী বর্ষা মৌসুমের আগেই পরশুরামে সাম্প্রতিক ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মুহুরী নদী সংলগ্ন নিজ কালিকাপুর বল্লামুখার বাঁধ নির্মাণের আশ্বাস দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এহসানুল হক।

শনিবার (২ নভেম্বর-২০২৪ ) বিকেলে পরশুরামের মির্জানগর ইউনিয়নের নিজ কালিকাপুরে সরেজমিনে বল্লামুখার বাঁধ পরিদর্শন এসে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে আগামী বর্ষা মৌসুমের আগেই বল্লারমুখার বাঁধ নির্মাণের আশ্বস্ত দিয়েছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র এই সচিব এবং এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আলোচনা করা হবে বলে জানান।অপরদিকে

পরশুরামে বল্লামুখার বাঁধসহ মুহুরী, কহুয়া সিলোনিয়া নদীতে স্থায়ী টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাকে স্মারকলিপি প্রদান করে স্থানীয়রা। গত ২০২৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর সকাল ১০ টায় নিজ কালিকাপুরে বল্লামুখা বাঁধ ও মুহুরী নদী পরিদর্শনকালে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের কাছে টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি জানিয়ে মানববন্ধন করে স্থানীয়রা। এসময় এলাকাবাসীর পক্ষে উপদেষ্টার হাতে স্মারকলিপি প্রদান করেন ফেনী জেলা আইনজীবী সমিতির যুগ্ম সম্পাদক এডভোকেট এমদাদ হোসাইন।

স্থানীয় জহিরুল ইসলাম জানান, স্মারকলিপিতে ভারতীয় পানি আগ্রাসন রোধকল্পে ফেনীবাসীকে ভয়াবহ বন্যার হাত থেকে রক্ষা করার জন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টেকসই বাঁধ নির্মাণের প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়েছে।

পরে ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ড বল্লারমুখা এসব ভাঙন মেরামতে প্রায় ৭ কোটি টাকা বরাদ্ধ দিয়েছে। সপ্তাহ খানেক ধরে বাঁধের পুননির্মাণের কাজ করে আসছে ঠিকাদার। গত বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারী) সকালে ভারতীয় বিএসএফ বাঁধ পুনর্নির্মাণে বাঁধা প্রদান করে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। বর্ষার মওসুম আসার আগে নিজেদের বাড়ি-ঘর ও সহায় সম্বল বাঁচাতে বল্লামুখা বাঁধ পুননির্মাণ নিয়ে অস্তিরতা বিরাজ করছে স্থানীয় বাংলাদেশীদের মধ্যে।

স্থানীয়রা জানান, বল্লামুখা বেড়িবাঁধে ১৯০ মিটারের কাজে বিএসএফ বাধা প্রদান না করলেও অপর অংশের ৭০ মিটার বাঁধ পুননির্মাণে বাঁধা প্রদান করে। ৭০ মিটার বাঁধের অংশে ৩০ মিটার দু-দেশের সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে বলে ভারতীয় বিএসএফ এমন অভিযোগ করে বেড়িবাঁধ পুনর্নির্মাণে বাঁধা প্রদান করে।

ঠিকাদারের প্রতিনিধি ও স্থানীয় বাসিন্দা কালা মিয়া (৪০) জানান, বিজিবির নিজ কালিকাপুর ক্যাম্পের সদস্যরা আমাদেরকে কাজ অব্যাহত রাখতে বলেছেন। এদিকে আগামী ৩রা ফেব্রুয়ারি বল্লামুখা বেড়িবাঁধের ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শনে আসছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান। এদিন পরশুরামে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত দুস্থদের জন্য জামায়াতে ইসলামীর সহায়তায় নির্মিত ঘর ও ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন তিনি। দুপুরে জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ফেনীর মহিপালে নিহত শহীদ পরিবার ও আহতদের সঙ্গে ফেনী শহরে মতবিনিময় করবেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড ফেনীর নির্বাহী প্রকৌশলী আক্তার হোসেন মজুমদার জানান, বল্লারমুখ বাঁধের কাজ ঠিকাদার অব্যাহত রেখেছে বলে জেনেছি। এ ব্যাপারে বিজিবি’র ফেনীর ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মোশারফ হোসেন জানান, দেড়শ গজের বাইরের অংশে বাঁধ পুনর্নির্মাণের কাজ চলছে, ৩০ মিটার জায়গায় আপত্তির বিষয়ে মন্ত্রণালয় কাজ করছে। প্রসঙ্গত, উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের নিজ কালিকাপুরে ভারত সীমান্তে মুহুরী নদীসংলগ্ন চরের পশ্চিমে-দক্ষিণে রয়েছে একটি মরা নদী। সেটি বল্লামুখার খাল নামে পরিচিত। বল্লামুখার খাল নিজ কালিকাপুর থেকে শুরু হয়ে রাঙ্গামাটিয়া, ফকিরের খিল, উত্তর কাউতলী, বাইন্যা গ্রাম, ডিএম সাহেবনগর, মেলাঘর, মির্জানগর, গদানগর, পূর্ব সাহেবনগর, কালীকৃষ্ণনগর গ্রাম দিয়ে সিলোনিয়া নদীতে মিলিত হয়েছে।