মো: আবু তাহের পাটোয়ারী:
২০২৪ সালের “জুলাই বিপ্লব” বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। দীর্ঘদিনের বৈষম্য, দুর্নীতি ও শাসন ব্যবস্থার চরম ব্যর্থতার বিরুদ্ধে দেশের আপামর জনগণ ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার সরকারের ১৬ বছরের ধারাবাহিক নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে । এই অভূতপূর্ব গণআন্দোলনের প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। জাতীয় প্রত্যাশা ছিল, তিনি একটি বিপ্লবী সরকার গঠন করে নতুন শাসন কাঠামোর সূচনা করবেন। কিন্তু বাস্তবে তিনি মধ্যপন্থী ও সাংবিধানিক ধারার অন্তর্গত একটি অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিতর্ক আজও বহমান — ইতিহাসের বিচারে এটি ছিল কি বিচক্ষণতা, নাকি সাহসের অভাব?
এই লেখায় আমরা জুলাই বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে বিপ্লবী সরকার গঠন না করার সুবিধা ও অসুবিধা বিশ্লেষণ করবো।
সুবিধা
আন্তর্জাতিক বৈধতা ও কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা
একটি বিপ্লবী সরকার অনেক সময় বৈশ্বিক পর্যায়ে স্বীকৃতির সঙ্কটে পড়ে। বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা ও স্বীকৃতি অপরিহার্য। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের মাধ্যমে ড.মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর মধ্যে রেখে দেন, ফলে বৈদেশিক সাহায্য, বাণিজ্য ও কূটনৈতিক সমর্থন বজায় রাখা সহজে সম্ভব হয়।
তাৎক্ষণিক গৃহযুদ্ধ বা সংঘাত এড়ানো
জুলাই বিপ্লবের উত্তাল মুহূর্তে বিপ্লবী সরকার গঠন করলে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা ধসে পড়ার আশঙ্কা ছিল। বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী ও পুরনো শাসকচক্র সশস্ত্র প্রতিরোধে নেমে আসতে পারত। অন্তর্বর্তীকালীন শাসন সংযম প্রদর্শনের মাধ্যমে এক বৃহৎ রক্তক্ষয় এবং সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ এড়াতে সহায়ক হয়েছে।
জাতীয় ঐক্য রক্ষার প্রচেষ্টা
র্যাডিকাল পরিবর্তন প্রায়শই সমাজের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে তীব্র বিভাজন সৃষ্টি করে। অধ্যাপক ইউনূস একটি অন্তর্বর্তী, আপাত-নিরপেক্ষ প্রশাসনের মাধ্যমে সকল পক্ষের মধ্যে আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত রাখার চেষ্টা করেন, যাতে করে জাতীয় ঐক্য যে-কোনো ভাবে টিকে থাকে।
সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখা
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে সংবিধানের ছাতার নিচে থেকেই পরিবর্তনের প্রচেষ্টা করা হয়। এতে দীর্ঘমেয়াদে আইনি ভিত্তি মজবুত রাখা সম্ভব হয়, যা পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রের পুনর্গঠনে সহায়ক হতে পারে।
অসুবিধা
বিপ্লবের চেতনার অপচয়
জুলাই বিপ্লবের মূল অনুপ্রেরণা ছিল এক নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের প্রত্যয়। বিপ্লবী সরকার গঠিত না হওয়ায় এই আদর্শিক শক্তি হারিয়ে যায়। পরিবর্তনের পরিবর্তে একটি সাময়িক সমঝোতার পথে হাঁটায় জনমনে গভীর হতাশা সৃষ্টি হয়।
পুরনো শাসকচক্রের পুনরুত্থান
যখন মৌলিক রাজনৈতিক কাঠামো ধ্বংস হয় না, তখন পুরনো স্বার্থান্বেষী শক্তিগুলি নতুন মুখোশে ফিরে আসে। অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার ফলে দুর্নীতিবাজ আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক এলিট শ্রেণি পুনরায় ক্ষমতার কেন্দ্রে ফিরে আসতে সক্ষম হয়, যা বিপ্লবের অর্জনকে নস্যাৎ করে।
গণমানুষের প্রত্যাশার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা
জুলাই বিপ্লব সাধারণ জনগণের বিপুল আত্মত্যাগের ফল। বিপ্লবী সরকার গঠন না করে একটি মাঝামাঝি সমাধানের দিকে যাওয়ায় জনগণের মধ্যে বিশ্বাসের সংকট সৃষ্টি হয়। অনেকের কাছে এই সিদ্ধান্ত আত্মসমর্পণ বা রাজনৈতিক আপোষের প্রতিচ্ছবি হিসেবে প্রতিভাত হয়।
ভবিষ্যৎ অস্থিতিশীলতার ভিত্তি
যখন বিপ্লবী সম্ভাবনাকে দমন করা হয়, তখন তার ক্ষোভ চাপা থাকে, মিটে যায় না। ফলে ভবিষ্যতে আরও বৃহত্তর অস্থিরতা ও সহিংস আন্দোলনের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার উপর এর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সিদ্ধান্ত তার সময়ের বাস্তবতা ও আন্তর্জাতিক জটিলতাকে বিবেচনায় নিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তবে ইতিহাসের কঠিন সত্য হলো, বিপ্লবের মুহূর্তে প্রয়োজন হয় সাহসী ও দূরদর্শী নেতৃত্বের। সংযমের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক সংঘাত এড়ানো সম্ভব হলেও, আদর্শগত সংকল্পহীনতা বিপ্লবের লক্ষ্য ও জনগণের স্বপ্নকে ব্যর্থ করে দেয়।
জুলাই বিপ্লবের অধ্যায় তাই আমাদের শেখায় — কোনও জাতির মৌলিক পরিবর্তনের জন্য শুধুমাত্র সমঝোতা নয়, প্রয়োজন দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি ও সময়োপযোগী সঠিক সিদ্ধান্ত। বিপ্লবী মুহূর্তের ভুল সিদ্ধান্ত জাতির ভবিষ্যতকে দীর্ঘ সময়ের জন্য দিশাহীন করে তুলতে পারে। ইতিহাস একদিন হয়তো এ সিদ্ধান্তকে বিচক্ষণতা নয়, এক বড় রাজনৈতিক সুযোগহানির দৃষ্টান্ত হিসেবেই মূল্যায়ন করবে।