৫ মে শাপলা চত্বরে ‘অভিযান’: নিহত, নিখোঁজ আর রক্ত মোছার করুণ দৃশ্য

মো: আবু তাহের পাটোয়ারী -ঢাকা, ৫ মে ২০২৫
২০১৩ সালের ৫ মে, ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ডাকা সমাবেশে অংশগ্রহণকারী হাজারো মানুষের ওপর রাতে চালানো হয় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযান। এ অভিযানে কতজন নিহত হন, তা নিয়ে এখনো রয়েছে ধোঁয়াশা। যদিও সরকারি ভাষ্যে একে “পরিচ্ছন্নতা অভিযান” বলা হয়েছে, তবু বিভিন্ন সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে উঠে আসে এক ভয়াবহ, রক্তাক্ত চিত্র।

হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে ১৩ দফা দাবিতে আয়োজিত সমাবেশটি বিকেল গড়াতেই বিশাল জমায়েতে রূপ নেয়। সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয় চারপাশ থেকে অবস্থানকারীদের ঘিরে ফেলা, এবং রাত ২টার পর শুরু হয় অভিযান। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট ও জলকামান ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের সরানোর চেষ্টা চলে দীর্ঘ সময় ধরে। প্রত্যক্ষদর্শীরা দাবি করেন, প্রাণহানিও ঘটে, যদিও সরকারিভাবে তা স্বীকার করা হয়নি।

হাসপাতাল ও সংবাদপত্রগুলোর ভাষ্যমতে, বহু লাশ গুম করা হয়েছে, পরিবারগুলো খুঁজে পায়নি প্রিয়জনকে। কিছু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিও ও ছবি রাতভর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইঙ্গিত দেয়।

পরদিন ৬ মে সকাল, বায়তুল মোকাররম মসজিদ ও এর আশপাশের এলাকায় দেখা যায়, ঝাড়ুদার কিংবা মসজিদের খাদেম মেঝেতে লেগে থাকা রক্ত মোছার চেষ্টা করছেন। ওই দৃশ্য অনেকের মনে গভীর দাগ কেটে যায়—যেন ইতিহাস থেকে সত্য মুছে ফেলার নিরর্থক প্রয়াস। রক্ত মোছার সে দৃশ্য আজও ভেসে ওঠে গণমানুষের স্মৃতিতে।

মানবাধিকার সংস্থা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এ ঘটনাকে ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে স্বৈরাচারী শক্তির নগ্ন প্রকাশ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। আন্তর্জাতিক কিছু সংবাদমাধ্যম যেমন আল-জাজিরা, বিবিসি ও নিউইয়র্ক টাইমস এ বিষয়ে খবর প্রকাশ করলেও সরকার বরাবরই এ ঘটনাকে ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার প্রচেষ্টা’ হিসেবে ব্যাখ্যা করে আসছে।

১২ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও প্রশ্ন থেকেই যায়—৫ মে রাতে শাপলা চত্বরে কী ঘটেছিল? কতজন নিহত হয়েছিলেন? কারা নিখোঁজ? এবং সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—এ ঘটনার দায়ভার কে নেবে?।

প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান:
ঘটনার সময় বায়তুল মোকাররমের পাশেই অবস্থানরত এক দোকানদার জানান, “রাত ৩টার দিকে হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায়। তারপর গুলি আর চিৎকারে চারপাশ কেঁপে ওঠে। চোখে মুখে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। পরদিন সকালে রাস্তার ধারে রক্ত আর স্যান্ডেল ছড়িয়ে ছিল।”

এক স্বেচ্ছাসেবক সংস্থার সদস্য বলেন, “সকালবেলা আহতদের খুঁজে হাসপাতালে পাঠাচ্ছিলাম। একাধিক মৃতদেহের চিহ্ন পাওয়া যায়, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছবি তুলতে দিচ্ছিল না।”

পরিসংখ্যান (বেসরকারি সূত্র অনুযায়ী):

নিহত: আনুমানিক ৫০ থেকে ২০০ জন (সুনির্দিষ্ট তথ্য অনুপস্থিত)

আহত: প্রায় ৫০০+নিখোঁজ: ৫০ জনের বেশি, যাদের অনেকেই আজও ফিরে আসেনি

গ্রেফতার: শতাধিক, যাদের মধ্যে অনেককে পরে মুক্তি দেওয়া হয়।

মানবাধিকার সংস্থার প্রতিক্রিয়া:
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ ঘটনার সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ তদন্ত দাবি করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতিতে বলে, “নিরস্ত্র ধর্মীয় কর্মীদের ওপর এই ধরনের আক্রমণ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।”

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়, যেন তারা ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে এবং দায়ীদের বিচারের আওতায় আনে।

এক দশকেরও বেশি সময় পার হলেও ৫ মে ২০১৩-র সেই ভয়াবহ রাত আজও আমার মত অনেকের জন্য দুঃস্বপ্নের নাম।রাত ৮ টায় একব্যক্তির বিশেষ অনুরোধে বাসায় চলে যাই।সকাল ৭টায় দিগন্ত টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ দেখে দ্রুত মতিঝিল শাপলা চত্বরে এসে অনেক ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে বিস্তারিত ভাবে অবগত হই।গোলাপবাগ মাঠে সিটি কর্পোরেশন দুই ট্রাক জুতা এনে রেখেছে ;সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ভয়াবহ স্মৃতি আজোও তাড়িয়ে বেড়ায় আমাকে। রাষ্ট্র, সমাজ ও মানবতা—সকলের কাছে এ প্রশ্ন রয়ে গেছে: ইতিহাস কি কখনও এর জবাব দেবে?