ইসরায়েলের দিকে ইরানের নতুন মারণাস্ত্র: ক্লাস্টার বোমার ছায়া নেমে এলো

নবজাগরণ প্রতিবেদন:২০ জুন ২০২৫
আজ সকালে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধাবস্থায় নতুন এক ধাপে প্রবেশ করেছে। ইরান প্রায় ৪০টির বেশি নতুন ধরণের ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের বিভিন্ন সামরিক ও কৌশলগত স্থাপনার দিকে নিক্ষেপ করেছে। তবে শুধু সংখ্যায় নয়, এসব হামলার প্রকৃত ভয়াবহতা লুকিয়ে আছে ব্যবহৃত অস্ত্রের ধরনের ভেতরে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী এবং গোপনচর সংস্থাগুলোর ধারণা-এই প্রথমবারের মতো ইরান ক্লাস্টার বোমা ব্যবহারের পথে হাঁটল। ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের হাইফা, কারমেল পাহাড়ের সামরিক ঘাঁটি ও নেভাতিম বিমানঘাঁটির আশপাশে বিস্ফোরণের চিহ্ন বিশ্লেষণ করে এমনটাই নিশ্চিত হওয়া গেছে।

কীভাবে কাজ করে এই ক্লাস্টার বোমা?

সাধারণ মিসাইল বা বোমা যেখানে একটি বিস্ফোরণ ঘটায়, ক্লাস্টার বোমা সেখানে অজস্র ক্ষুদ্র সাব-মিউনিশন বা ছোট বোমা আকাশেই ছড়িয়ে দেয়।
ইসরায়েলি সামরিক সূত্র জানায়

> “এই বোমাগুলো সাধারণত উচ্চমাত্রার উচ্চতায় বিস্ফোরিত হয়, এবং তারপর ৮ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে বৃষ্টির মতো পড়ে। ফলে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা আয়রন ডোমের পক্ষে সবকিছু ধ্বংস করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।”

ক্লাস্টার বোমার আরও এক ভয়ংকর দিক হলো, এর সব সাব-বোমা একসাথে বিস্ফোরিত হয় না। অনেক সময় এগুলো মাটিতে অবিস্ফোরিত অবস্থায় পড়ে থাকে, যা শিশু, সাধারণ মানুষ এমনকি উদ্ধারকর্মীদের জন্যও ভবিষ্যতে মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়ায়।

যুদ্ধের মাঠে বিপজ্জনক মোড়

বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্লাস্টার বোমার ব্যবহার যুদ্ধ পরিস্থিতিতে একটি বড় মনস্তাত্ত্বিক ও কৌশলগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
রাশিয়ার এক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক জানিয়েছেন-

“এই অস্ত্র কৌশলগত দিক থেকে ব্যবহার করলে শত্রুপক্ষের সামরিক ঘাঁটিগুলো কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, এবং শহরাঞ্চলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।”

ইসরায়েলের এক উচ্চপদস্থ নিরাপত্তা কর্মকর্তা জানিয়েছেন
“আমরা এই হামলায় এমনসব বোমার অংশ পেয়েছি যা এখনও বিস্ফোরিত হয়নি। ফলে আমাদের সন্ত্রাস-বিরোধী ইউনিট ও উদ্ধারকারী টিম বিপদের মুখে রয়েছে।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
ইরানের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এখনও আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি আসেনি। তবে সিরিয়া, লেবানন এবং ইরাকের ইরান-ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীগুলো এই হামলাকে “প্রতিরোধের গর্ব” হিসেবে বর্ণনা করেছে।
জাতিসংঘের যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত একটি সাব-কমিটি ইতোমধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ক্লাস্টার বোমার ব্যবহারে সাধারণ জনগণের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে।

❗ ভবিষ্যতের শঙ্কা
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যদি সত্যিই ইরান এই ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তবে তা শুধু ইসরায়েলের জন্য নয়, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জন্য এক বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারে।

পরিস্থিতি যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে আঞ্চলিক যুদ্ধ আর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে পার্থক্য দিনে দিনে মুছে যেতে বসেছে।

মানবিক বিপর্যয়ের নতুন ছায়া
ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের কিছু আবাসিক এলাকা, যেমন কিরিয়াত শমোনা, নাহারিয়া ও হাইফার শহরতলি, এই বোমার আঘাতে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন স্থান থেকে ছড়িয়ে পড়া উপ-বোমাগুলো (submunitions) বহু ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়েছে এবং বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে। ইতিমধ্যে স্থানীয় প্রশাসন হাজার হাজার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে।

ইসরায়েলের এক নাগরিকের সাক্ষাৎকারে জানা যায়-
“আমরা এক মুহূর্তে বুঝতেও পারিনি আকাশ থেকে কী নামছে! কিছু একটা বিস্ফোরিত হলো না, কিন্তু পরেই বিস্ফোরণের শব্দ এল ঘরের পেছন থেকে। পরে দেখলাম মাঠের মধ্যে এক গোলাকার ছোট বস্তু পড়ে আছে। সেনারা এসে জানাল এটা ক্লাস্টার বোমার অংশ।”

সেনা সূত্র জানিয়েছে, এই বোমাগুলোর কিছু এখনো নিষ্ক্রিয় অবস্থায় মাটিতে রয়ে গেছে, যা যেকোনো সময় বিস্ফোরিত হয়ে শিশু বা সাধারণ মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে।

কৌশলগত পাল্টা আঘাতের আশঙ্কা
ইসরায়েল ইতোমধ্যেই দাবি করেছে যে তারা ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের (IRGC) কিছু রকেট ঘাঁটি শনাক্ত করেছে, যেখান থেকে এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো উৎক্ষেপণ করা হয়েছে।
বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলের মিত্ররা-বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স-এই হামলাকে স্পষ্টতই একটি “অসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধমূলক হামলা” হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।

তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই মুহূর্তে ইসরায়েল সরাসরি ইরানে পাল্টা আঘাত করলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে ভয়ংকর যুদ্ধাবস্থা তৈরি হতে পারে।
আন্তর্জাতিক আইন ও যুদ্ধাপরাধ বিতর্ক

জাতিসংঘের “Convention on Cluster Munitions” অনুযায়ী ক্লাস্টার বোমার ব্যবহার মানবাধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘন। তবে ইরান ও ইসরায়েল-দুই দেশই এই চুক্তির সদস্য নয়।

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেন-
“অস্ত্রের এমন ব্যবহার, যা সাধারণ মানুষের জীবনকে দীর্ঘমেয়াদে হুমকির মুখে ফেলে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”

মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ইতোমধ্যেই স্বতন্ত্র তদন্ত দাবি করেছে, বিশেষ করে অবিস্ফোরিত বোমার প্রভাবে ভবিষ্যতে শিশুদের ক্ষতির আশঙ্কার বিষয়টি সামনে এনে।

পরিণতি ও বিশ্ব রাজনীতির দোদুল্যমানতা

এই ক্লাস্টার বোমা ব্যবহার শুধুমাত্র একটি অস্ত্রগত পরিবর্তন নয়, এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক এবং কূটনৈতিক সংঘর্ষের দরজাও খুলে দিচ্ছে।
বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, যুদ্ধ যদি এই গতিতে এগোয়, তবে খুব দ্রুত সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন, এমনকি পাকিস্তান বা ভারতীয় উপমহাদেশও এই সংঘাতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে যেতে পারে।

ইসরায়েলের নৈতিকভাবে পরাজয়ের একসিঁড়ি অবশিষ্ট: আগুন নিয়ে খেলা?

ইরান যদি সত্যিই ক্লাস্টার বোমা ব্যবহার করে থাকে, তবে তা কেবল ইসরায়েলের জন্য নয়, বরং পূর্ব ও পশ্চিম বিশ্বের মাঝে একটি অঘোষিত যুদ্ধের সূচনা হয়ে গেল।

এটা এখন স্পষ্ট, আরব বসন্তের মতো, এই যুদ্ধও আর “স্থানীয়” থাকছে না।

সাক্ষাৎকার: হাইফার এক নারী শিক্ষক, ইসরায়েলি বোমা ডিসপোজাল ইউনিটের এক সদস্য

পরিসংখ্যান: আগের ক্লাস্টার বোমা হামলার গ্লোবাল ডেটা (লেবানন ২০০৬, সিরিয়া ২০১২, ইউক্রেন ২০২৩)

প্রতিবেদন: নবজাগরণ সংবাদ টিম।