বিচার চাই, মব নয়: আইনের শাসন বনাম প্রতিশোধের সংস্কৃতি

নবজাগরণ ডেস্ক:
একটি রাষ্ট্র যখন দীর্ঘদিন অবিচার, দমন-পীড়ন ও গণতন্ত্রহীনতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন জনতার ক্ষোভ ধীরে ধীরে স্ফুলিঙ্গে পরিণত হয়। তখন রাষ্ট্রযন্ত্র, আদালত, এমনকি রাজনৈতিক ব্যবস্থার উপর থেকে আস্থা উঠে যায় মানুষের। ঠিক তখনই দেখা দেয় ‘মব জাস্টিস’ বা জনতার হাতে প্রতিশোধের প্রবণতা।

সম্প্রতি সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদাকে জনসমাগমে লাঞ্ছিত করার ঘটনা এই প্রবণতারই একটি প্রতিফলন। হ্যাঁ, তিনি ছিলেন ভোটচুরির প্রতীক। হ্যাঁ, তার অধীনে এক ভয়ংকর একদলীয় নির্বাচন হয়েছিল। কিন্তু প্রশ্ন হলো-এই ক্ষোভ কি এখন আদালতের কাঠগড়ায় পৌঁছাবে, না কি রাস্তায় প্রতিশোধের চক্রে ঘুরপাক খাবে?

অপরাধীরও মানবাধিকার থাকে-এটাই সভ্যতা

আমরা ভুলে যাই-যে রাষ্ট্র একদিন জনগণের হয়ে একদলীয় স্বৈরতন্ত্রের বিচার করবে, সেই রাষ্ট্রই পরদিন এক ভিন্ন মতাবলম্বীর কণ্ঠ রুদ্ধ করতে সেই একই ‘মব’ বা বিচারবহির্ভূত শক্তি ব্যবহার করতে পারে। আজ যদি আমরা লাঞ্ছনার মাধ্যমে প্রতিরোধ করি, কাল সেই ছুঁতোয় আমাদেরই কণ্ঠ রুদ্ধ হবে।

মানবাধিকার শুধু নিরীহ মানুষের জন্য নয়-অপরাধীর জন্যও মানবাধিকার আছে। তার বিচার হবে, তদন্ত হবে, প্রতিটি অভিযোগের আইনি মোকাবিলা হবে। এটাই একটি গণতান্ত্রিক, সভ্য রাষ্ট্রের মূলনীতি। যিনি গুম করেছেন, ভোট ডাকাতি করেছেন, তিনি ‘অপরাধী’ হোন বা ‘সাবেক কর্মকর্তা’-তার বিচার প্রাতিষ্ঠানিক রূপেই হতে হবে।

প্রতিশোধ নয়, প্রতিরোধ হোক শৃঙ্খলার ভিতর

আমরা কি এক স্বপ্নের নতুন বাংলাদেশের কথা বলি না, যেখানে থাকবে না ‘হরর রেজিম’ বা ভয়-ভীতি? তাহলে প্রতিরোধও হোক শৃঙ্খলা, নৈতিকতা এবং সাংবিধানিক কাঠামোর ভিতর দিয়ে। আমরা চাই বিচারের সংস্কৃতি, রাজনৈতিক প্রতিশোধের নাড়ি কেটে দেওয়া এক নতুন রাষ্ট্র।

বিচারব্যবস্থা যখন বিকল, তখন জনগণ রাস্তা নামতে বাধ্য হয়। কিন্তু আমাদের এখনকার করণীয় হলো সেই বিকল ব্যবস্থাকে সংস্কার করা, জনতার চাপের মুখে বিচারব্যবস্থাকে জাগ্রত করা-জনগণের রোষকে মব নয়, সাংবিধানিক শক্তিতে পরিণত করা।

নতুন বাংলাদেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য যা জরুরি:

১. ভোট ডাকাতির অপরাধে কমিশনের সদস্যদের বিরুদ্ধে আইনি তদন্ত শুরু হোক।

২. একটি স্বাধীন ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ট্রুথ কমিশন’ গঠিত হোক।

৩. মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হোক।

৪. বিচারহীনতার সংস্কৃতি ভাঙতে হাই-প্রোফাইল ট্রায়াল শুরু হোক—স্বচ্ছ, জনসমক্ষে।

৫. মব জাস্টিসকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিন্দা করা হোক—কিন্তু তার উৎস (অবিচার) নির্মূল করেই।

বিচার চাই কিন্তু মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়-মব- নয়?
আমরা ‘স্বৈরাচারের বিচার’ চাই। তবে সেই বিচার হতে হবে আইন ও ন্যায়নীতির পথ ধরে। যেন আগামী প্রজন্ম দেখতে পায়-বাংলাদেশ প্রতিশোধ নয়, ন্যায়বিচারে বিশ্বাস করে।
আমরা রাষ্ট্র চাই, যেখানে ভোটচোর কাঁদে আদালতের কাঠগড়ায়-নয় জনতার থাপড়ে নয়, বরং জনতার দেওয়া সাক্ষ্যে।