মো.আবু তাহের পাটোয়ারী:
ড.মুহাম্মদ ইউনূস‘জাতীয় সংস্কারক’হতে চান না-এটা যেমন তাঁর বিনয়,তেমনি বর্তমান সংকটকালীন রাষ্ট্রীয় বাস্তবতায় এটি এক কৌশলগত অবস্থানও হতে পারে। কেননা,বাংলাদেশের ইতিহাসে যে পর্যায়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি,সেখানে একটি খেতাবের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি হচ্ছে নেতৃত্ব, দিকনির্দেশনা এবং রাষ্ট্রান্তরের সাহসী রোডম্যাপ।
‘সংস্কারক’ শব্দে সংকটের মোড়ক?
প্রশ্ন হলো-সংস্কার কাদের জন্য, কেন? একটি গণহত্যাপরায়ণ, দুর্নীতিগ্রস্ত, দলীয়করণে পরিপূর্ণ রাষ্ট্রযন্ত্র কি শুধুই ‘সংস্কার’-এ মুক্তি সম্ভব? নাকি প্রয়োজন মূলগত রাষ্ট্রান্তর-একটি নতুন সমাজচুক্তি?
‘জাতীয় সংস্কারক’ একটি নিরাপদ শব্দ, তাতে রাজনীতির গন্ধ নেই, বিদ্রোহ নেই, শাসকের ভ্রূকুটি নেই। কিন্তু এই জাতি কি এখনো “সংস্কার” নামের চোখরাঙানি ঠেকাতে পারবে? যে দেশে বিচারব্যবস্থা দলীয় ম্যান্ডেটে চলে, পুলিশ সন্ত্রাস ছড়ায়, সেনাবাহিনীও রাজনৈতিক বিভক্তি ও বিদেশি প্রভাবের কবলে-সেখানে “সংস্কার” শব্দটি আসলে বিপ্লবের বিকল্প নয়, এটি স্থিতাবস্থার একধরনের মেকআপ মাত্র।
ড.ইউনূস কি পারবেন ‘আলোচক’ থেকে ‘নির্মাতা’ হতে?
ড. ইউনূস আজ কেবল একজন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ নন-তিনি একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রের সামনে চরম প্রত্যাশার প্রতীক।
তিনি যদি সত্যিই জাতির সঙ্কট অনুধাবন করেন, তবে তাঁকে খেতাবের বাইরে গিয়ে “রাষ্ট্রগঠনের মহানায়ক” হয়ে উঠতে হবে।
তিনি ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন, কিন্তু প্রশ্ন হলো-এই কমিশনগুলো কি কেবল সুপারিশ তৈরি করবে? নাকি একটি নতুন সংবিধান, একটি গণ-ভিত্তিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণের পথপ্রদর্শক হবে?
হাইকোর্টের রুল:বিচারিক প্রতিবিম্ব, না জনতার আওয়াজ?
গত ১৪ জুলাই হাইকোর্ট রুল জারি করে জানতে চেয়েছে-কেন ড.ইউনূসকে জাতীয় সংস্কারক ঘোষণা করা হবে না, কেন জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদদের জাতীয় শহীদ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না। এ রুলের পেছনে রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক উদ্যোগ-যা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির সংকটে ইতিহাস ও শহীদদের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা।
এখানে প্রশ্ন একটাই:
জুলাই অভ্যুত্থান কি ছিল কেবল ছাত্র জনতার সাময়িক বিদ্রোহ, না কি একটি গণঅভ্যুত্থানের সূচনা?
যদি ২০২৪ সালের জুলাই হয় বাংলাদেশের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের সূচনা,তাহলে সেই আন্দোলনের শহীদরা কেন আজও জাতীয় শহীদ’নন?
সরকারের ও দূরত্ব: কৌশল নাকি ষড়যন্ত্র?
সরকারি বিবৃতি বলছে,ড.ইউনূস নিজেই খেতাব চান না, সরকারও দিতে চায় না। এই নির্লিপ্ততা কোনো নিরপেক্ষতা নয়। এটি মূলত রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে প্রতিরোধের ইঙ্গিত, একটি অদৃশ্য স্ট্যাটাস-কো ফোর্সের প্রতিরক্ষা-প্রচেষ্টা।
এই তথাকথিত “নিরপেক্ষতা”দিয়ে আসলে জুলাই বিপ্লব, শহীদদের আত্মত্যাগ,এবং রাষ্ট্রান্তরের প্রয়োজনে জনদাবি-সবকিছুকেই খাটো করার চেষ্টা চলছে।
আমরা কী চাই?
আমরা চাই-
জুলাই অভ্যুত্থানের প্রকৃত ইতিহাস সরকারিভাবে প্রকাশ হোক।
শহীদদের ‘জাতীয় শহীদ’ ঘোষণা করা হোক।
ড.ইউনূস কেবল সংস্কার নয়,‘রাষ্ট্রান্তরের প্রধান স্থপতি’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করুন।
নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য একটি সর্বজনীন সংবিধান পরিষদ গঠন হোক।
সেনা, পুলিশ, প্রশাসন-সব প্রতিষ্ঠানে দলীয়করণ ও বিদেশি হস্তক্ষেপের অবসান ঘটিয়ে জনতার গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হোক।
এখন ইতিহাসের মোড়লিপি বদলানোর সময়।
‘জাতীয় সংস্কারক’নয়-আমরা চাই জাতীয় মুক্তির রূপকার।
ড.ইউনূস ইতিহাসের এক অদ্বিতীয় সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে।
তিনি চাইলে খেতাব নয়, একটি নতুন বাংলাদেশের জনক হয়ে উঠতে পারেন।
আপনার মতামত দিন, শেয়ার করুন। এই লেখা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকুক।
লেখক:সম্পাদক,
সাপ্তাহিক নবজাগরণ।
বিস্তারিত জানতে পড়ুন :
www.thenabajagaran.com