রাঙ্গামাটি থেকে নতুন বাংলাদেশ গঠনের ডাক:পাহাড়ী-বাঙালির ঐক্যে এনসিপির বিপ্লবী পদযাত্রা

রাঙ্গামাটি থেকে নতুন বাংলাদেশ গঠনের ডাক:পাহাড়ী-বাঙালির ঐক্যে এনসিপির বিপ্লবী পদযাত্রা

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
জুলাই পদযাত্রার আজ বিশতম দিন।সেই পদযাত্রা পৌঁছেছে রাঙ্গামাটি-যেখানে প্রকৃতি আর মানুষ একত্রে তৈরি করেছে এক অনন্য জীবনচিত্র। এই জনপদে পাহাড়ি-বাঙালির সহাবস্থান কেবল সহনশীলতার নয়, বরং এক সম্মিলিত ভবিষ্যতের হাতছানি। এখানেই দাঁড়িয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দিলেন এক বৈপ্লবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের ডাক-

“এই দেশ কেবল সংখ্যাগুরুদের নয়-এই দেশ সবার। যে বাংলাদেশে পাহাড় ও সমতল একসঙ্গে বাঁচে, সেই বাংলাদেশেই এনসিপির স্বপ্ন।”

নতুন এক রাষ্ট্রচিন্তা: ভিন্নতায় নয়,ঐক্যে শক্তি
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রচলিত ধারণা বহুকাল ধরেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার আধিপত্যে পর্যবসিত হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি গড়ে উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম, বরিশাল, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, কক্সবাজারসহ বিভিন্ন অঞ্চল ও জাতিগোষ্ঠীর মিলিত অস্তিত্বে। ভাষা, ধর্ম, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, জীবনদর্শনে বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও আমরা সবাই এই ভূখণ্ডের সন্তান। এনসিপি এই বহুস্তর বিশিষ্ট বাস্তবতাকেই গ্রহণ করছে রাষ্ট্রদর্শনের মূল ভিত্তি হিসেবে।

একটি সভ্য রাষ্ট্র মানে কেবল রাজধানীকেন্দ্রিক প্রশাসন নয়; বরং সেটি হলো প্রত্যন্ত জনপদেও সমান মর্যাদা, ভাষা ও সংস্কৃতির স্বীকৃতি, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা।

গৌরবের রাঙ্গামাটি-সহাবস্থানের জীবন্ত পাঠশালা
রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি-এই তিন পার্বত্য জেলা কেবল পর্যটনের নাম নয়, এগুলো আমাদের রাষ্ট্রচিন্তার আয়না। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, খিয়াং, বম, ও বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে গড়ে ওঠা সহাবস্থান আমাদের বলে দেয়: সহমর্মিতা ও রাজনৈতিক স্বীকৃতিই শান্তির একমাত্র পথ।

কিন্তু এই পাহাড়েই আমরা দেখেছি রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের ইতিহাস। শান্তিচুক্তির পরও ভূমি অধিকার, সংস্কৃতি রক্ষা, মাতৃভাষায় শিক্ষা, উন্নয়ন বরাদ্দে বৈষম্য এবং নিরাপত্তা বাহিনীর আধিপত্যের নানা অভিযোগ পাহাড়িদের মন থেকে রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা কমিয়ে দিয়েছে। এনসিপি সেই আস্থার জায়গাটিতেই মৌলিক সংস্কার আনতে চায়।

জুলাই পদযাত্রা:স্লোগানের চেয়ে বেশি কিছু
এই পদযাত্রা আরেকটি রাজনৈতিক স্লোগানের নাম নয়; এটি একটি আদর্শিক অভ্যুত্থান। ‘এক জাতি এক ভাষা’-র মত মিথ্যে ঐক্যের ধোঁকা থেকে বেরিয়ে এসে‘বহুত্বের বাংলাদেশ’ গঠনের ডাক।
এনসিপির রাজনৈতিক দর্শন বলছে-রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামোকে কেন্দ্রীভূত নয়, বিকেন্দ্রীকৃত করতে হবে।

প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে।
পার্বত্য চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন এবং পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ভূমি অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগসহ স্থানীয় প্রশাসনে পাহাড়িদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।

এই দাবিগুলো কেবল পাহাড়িদের নয়-একটি সাম্য, মর্যাদা ও মুক্তির রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনে সকল প্রান্তিক মানুষের যৌথ আকাঙ্ক্ষা।
পাহাড়িদের প্রত্যাশা: ভয়ের বদলে মর্যাদার বাংলাদেশ
রাঙ্গামাটির পথসভায় আমরা শুনেছি তরুণ চাকমা যুবক বলছেন-

“বাংলাদেশকে আমরা ভালোবাসি,কিন্তু বাংলাদেশ কি আমাদের ভালোবাসে?রাষ্ট্রকে আমাদেরও মায়ের মতো আচরণ করতে হবে।”

এই কথার মধ্যে লুকিয়ে আছে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি পাহাড়ি জনগণের বঞ্চনার ইতিহাস ও আশা। তারা চায়-অস্ত্র নয়, সংলাপ। নিপীড়ন নয়, স্বীকৃতি। উন্নয়ন নয়, মর্যাদা। এনসিপি এই সত্যকেই রাষ্ট্রদর্শনের কেন্দ্রে এনে বলছে-
‘রাষ্ট্র নাগরিকের, জাতির নয়’-সুতরাং রাষ্ট্রকে সব নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব করতেই হবে।

ও আমার দেশের মাটি-
তোমার পরে ঠেকাই মাথা..
বাংলাদেশ কেবল এক পতাকা বা একটি জাতীয় সংগীত নয়। এটি হলো একটি সমন্বিত মানবিক পরিচয়ের নাম-যেখানে চাকমা শিশুর মুখে যেমন মাতৃভাষা থাকবে, তেমনি সমতলের কৃষকও মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে।

এনসিপি যে নতুন বাংলাদেশ গড়তে চায়, সেখানে ক্ষমতা হবে কেন্দ্রে নয়, জনগণের কাছে; জাতীয়তাবাদ হবে সংখ্যার নয়, মর্যাদার ওপর ভিত্তি করে; রাষ্ট্র হবে বন্দুকের নয়, নাগরিক অধিকারের পক্ষে। পাহাড়িদের স্বপ্ন আর বাঙালির আকাঙ্ক্ষা আজ এক জায়গায় মিলেছে রাঙ্গামাটির জনসভায়। এখান থেকেই শুরু হোক নতুন এক মুক্তিযুদ্ধ-মর্যাদার বাংলাদেশ গড়ার যুদ্ধ।
লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন সবাই।

লেখক:সম্পাদক ও প্রকাশক-সাপ্তাহিক নবজাগরণ।