বাংলাদেশের জনমত:শাসনের একচ্ছত্রতার সমাপ্তি-সংবিধান বদলের গণআদেশ

মোঃ আবু তাহের পাটোয়ারী:
দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকার বিপক্ষে ৮৯ শতাংশ মানুষ ;পিআর পদ্ধতির পক্ষে ৭১ শতাংশ।
বাংলাদেশে জনগণ স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দিয়েছে-রাজনীতির একচ্ছত্র আধিপত্যের যুগ শেষ। ক্ষমতার আসনে এক ব্যক্তির আজীবন বসবাস আর চলবে না। সুজনের সাম্প্রতিক জনমত জরিপ একথা প্রমাণ করেছে যেভাবে সংখ্যার ভাষায় ইতিহাস লেখা হয়-

৮৯% মানুষ বলেছে:একই ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না। ৭১% মানুষ চায়:উচ্চকক্ষে আসন বণ্টন হোক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (PR)পদ্ধতিতে-যাতে জনগণের প্রতিটি ভোটের সমান মূল্য থাকে।

৬৯% মানুষ সমর্থন করেছে: দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ-যেখানে নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ ক্ষমতার ভারসাম্য রাখবে।
এগুলো কেবল কিছু শতাংশ নয়-এগুলো ১৭ কোটি মানুষের পরিবর্তনচেতনার সংক্ষিপ্ত রূপ।

জনগণের বিপ্লবী এজেন্ডা:ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ ও জবাবদিহিতা
এই জরিপ মে-জুন ২০২৫-এ সারাদেশে ১৫টি সংলাপ ও ৪০টি প্রশ্নের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। অংশগ্রহণকারী ১,৩৭৩ জনের মধ্যে নারী, পুরুষ ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ছিলেন-যা সমাজের বহুমাত্রিক কণ্ঠকে প্রতিফলিত করে।

শাসন কাঠামোয় বড় পরিবর্তনের দাবিগুলো হলো:
মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার-৮৭%
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি-৮৮%
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন-৮৭%

রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা-৯০%
এগুলো প্রমাণ করে-বাংলাদেশের মানুষ শুধু সরকার পরিবর্তন নয়, রাষ্ট্র কাঠামো পুনর্গঠনের বিপ্লব চায়।

নির্বাচনী বিপ্লবের রূপরেখা
জরিপের ফলাফলে নির্বাচন ব্যবস্থার জন্য এক ধরনের গণসংস্কার ইশতেহার ফুটে উঠেছে-
চিহ্নিত সন্ত্রাসী, দুর্নীতিবাজ, সাজাপ্রাপ্তদের দলীয় সদস্যপদ বাতিল-৯২%
নির্বাচনী ব্যয় নিরীক্ষা বাধ্যতামূলক-৮৮%
স্বাধীন সীমানা নির্ধারণ কর্তৃপক্ষ-৮৪%
প্রবাসী ভোটার নিবন্ধন-৮৭%
‘না ভোট’ পুনঃপ্রবর্তন-৮৩%
নির্বাচন শেষে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ফলের সুষ্ঠুতা সার্টিফাই-৮৬%

এগুলো স্পষ্ট করে যে জনগণ ভোট ডাকাতি, দলীয় কমিশন, কালো টাকার খেলা ও বন্দুকবাজ প্রার্থীর যুগ শেষ করতে চায়। রাজনৈতিক দলের একনায়কতন্ত্র ভাঙার জনাদেশ
দলীয় অর্থায়নে ব্যাংকিং চ্যানেল বাধ্যতামূলক-৯১%
গোপন ভোটে প্রার্থী মনোনয়ন-৮৩%
স্বাধীন পুলিশ কমিশন-৯০%
দলের বিদেশি শাখা নিষিদ্ধ-৮০% এর মানে জনগণ আর দলীয় সর্দারতন্ত্র মেনে নিতে রাজি নয়।

বিচার ও প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ
বিভাগীয় শহরে হাইকোর্ট বেঞ্চ-৮৮% শক্তিশালী স্থানীয় সরকার-৮৪% উপজেলা পর্যায়ে আদালত-৮১%
স্থানীয় সরকার কমিশন-৯০%
এই দাবিগুলো প্রমাণ করে-রাজধানীকেন্দ্রিক ক্ষমতা ও বিচার ব্যবস্থার অবসান চাই জনগণ।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: কেন এই জনমত এখন বিপ্লবের ডাক
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যক্তিপূজা, পারিবারিক উত্তরাধিকার, দলীয় দখলদারিত্ব ও ক্ষমতার একচ্ছত্রতা-সব মিলিয়ে সংবিধান জনগণের হাতে নয়, দলীয় প্রধানদের হাতে বন্দী ছিল।
৭০ অনুচ্ছেদ থেকে শুরু করে মনোনয়ন বাণিজ্য, নির্বাচনী সন্ত্রাস-সবই গণতন্ত্রকে একধরনের ‘দলীয় কর্পোরেট লিমিটেড’-এ পরিণত করেছিল।

কিন্তু জুলাই ২০২৫-এর গণঅভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে-বাংলাদেশের মানুষ যখন রাস্তায় নামে, তখন তারা শুধু সরকার বদলায় না, রাষ্ট্রের খসড়া বদলে দেয়। এই জরিপ সেই বিপ্লবের সাংবিধানিক রূপরেখা।

বার্তা পরিষ্কার:দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয়-ক্ষমতার আসনে আজীবন বসে থাকার কালচার শেষ।
PR পদ্ধতি-প্রতিটি ভোটের সমান মর্যাদা।
বিকেন্দ্রীকরণ-রাজধানী একচ্ছত্রতার সমাপ্তি।
দলীয় গোপন সিন্ডিকেটের পতন-মনোনয়ন ও অর্থায়নে স্বচ্ছতা।

এটাই সময়-জনগণের গণআদেশকে সংবিধানে রূপান্তরিত করার। যদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই জনমত উপেক্ষা করে, তাহলে আগামী বিপ্লব কেবল রাস্তায় নয়-এবার সরাসরি সংসদের ভেতরে, সংবিধানের পাতায় লেখা হবে।