সহজ জীবনের অহংকার,কঠিন জীবনের শিক্ষা

মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
ভাবুন তো-আপনার জন্ম ১৯০০ সালে।
১৪ বছর বয়সে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো। স্কুলে পড়াশোনার ফাঁকে রেডিওতে যুদ্ধের খবর, পত্রিকার পাতায় শোক সংবাদ, আর আপনার চোখে দেখা প্রতিবেশী তরুণদের সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়া। যুদ্ধ শেষ হলো যখন আপনার বয়স ১৮, কিন্তু ততদিনে মারা গেছে ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ-এবং সেই শোক, সেই ক্ষত আপনার চারপাশে রক্তের দাগের মতো ছড়িয়ে আছে।

যুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র দুই বছরের মাথায়,আপনি ২০ বছরের তরুণ-কিন্তু বিশ্ব তখন স্প্যানিশ ফ্লু-এর গ্রাসে। কোনো আধুনিক হাসপাতাল নেই, ভ্যাকসিন নেই,স্যানিটেশন সীমিত। এই মহামারি ৫ কোটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিলো। মানুষ একে অপরকে ছোঁয়া থেকে ভয় পায়,অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় কোনো গান নেই-শুধু কান্না আর মাটি।

২৯ বছর বয়সে আপনি সাক্ষী হন মহামন্দা-র—১৯২৯ সালের শেয়ার বাজার ধস যেন পৃথিবীর চাকা থামিয়ে দিলো। রাতারাতি মানুষ দেউলিয়া, ব্যাংক বন্ধ, খাবারের লাইনে হাজার হাজার মুখ। রুটি-সুপ-চালের জন্য লড়াই করতে হয়।

৩৩ বছর বয়সে দেখলেন নাৎসিবাদ উত্থান। মানবসভ্যতার সবচেয়ে অন্ধকার ছায়া যখন দুনিয়ার উপর পড়লো, তখনও আপনি নিঃশ্বাস নিচ্ছেন, দেখছেন কিভাবে মানুষের ঘৃণা মানুষের রক্তে ভিজে যাচ্ছে।

৩৯ বছর বয়সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
৬ কোটি প্রাণ চলে গেলো,শহর ভস্মীভূত,পৃথিবী গন্ধে ভরে উঠলো গানপাউডার,ধ্বংসস্তূপ আর পুড়ে যাওয়া জীবনের গন্ধে। আপনি তখনও দাঁড়িয়ে,বেঁচে আছেন-শুধু শ্বাস নেয়ার জন্যও সাহস লাগে।

৫২ বছর বয়সে কোরীয় যুদ্ধ।
৬৪ বছর বয়সে ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরু হলো-শেষ হলো আপনি ৭৫ বছরে পা দিলে।

আপনি দেখেছেন যুদ্ধ,মহামারি, দুর্ভিক্ষ,অর্থনৈতিক পতন, রাজনৈতিক অন্ধকার-প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। আপনি দেখেছেন কিভাবে মানুষ মরে,আবার বাঁচে;কিভাবে সব হারিয়েও কেউ হার মানে না।

তারপর আসে ১৯৮৫ সালের প্রজন্ম।
তাদের জীবনে যুদ্ধ নেই, দুর্ভিক্ষ নেই,মহামারি (এমন মাত্রায়)নেই-কিন্তু অভিযোগ আছে,হাহাকার আছে,”লাইফ ইজ হার্ড”বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ট্যাটাস দেওয়া আছে। তারা মনে করে-দাদা-দাদিরা নাকি বুঝতেই পারে না জীবন কতটা কঠিন।

কিন্তু সত্য হলো-যে প্রজন্ম সবকিছু হারিয়ে আবার ঘর তুলতে শিখেছে,শূন্য থেকে জীবন সাজাতে শিখেছে,প্রিয়জনের মৃত্যু মেনে নিয়েও এগিয়ে গেছে-তারা জানে জীবন কতটা কঠিন, আর কতটা মূল্যবান।

আজকের আমাদের সহজ জীবনের প্রতিটি স্বস্তি এসেছে আগের প্রজন্মের রক্ত, ঘাম,আর অশ্রুর বিনিময়ে।
কিন্তু যদি আমরা অতীত ভুলে যাই,যদি আমরা নিজেদের ভোগান্তিকে মানবসভ্যতার সবচেয়ে বড় পরীক্ষা মনে করি-তাহলে আমরা শুধু অকৃতজ্ঞ নই,আমরা নিজেদের ভবিষ্যৎও বিপদে ঠেলে দিচ্ছি।

ইতিহাস আমাদের শেখায়-জীবন ভেঙে পড়ে,আবার গড়েও ওঠে। সাহস,সহনশীলতা আর দায়িত্বের নামই বেঁচে থাকা।
আগের প্রজন্ম তা প্রমাণ করেছে-প্রশ্ন হলো,আমরাও কি পারবো?