মো: আবু তাহের পাটোয়ারী :
বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার-শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। বিদেশগামী ও প্রবাসফেরত মানুষদের জন্য এটি শুধু একটি স্থাপনা নয়, বরং স্বদেশের প্রথম ছোঁয়া। কিন্তু এই ছোঁয়াটি এখন বিষাক্ত, লাঞ্ছনাময়, অপমানজনক। একে স্বাগত বলা চলে না, বলতে হয়-“স্বদেশে ফিরে গায়ে হাত, লাগেজে হাত, সম্মানে আঘাত!”
সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, একজন প্রবাসী ভিডিও ধারণ করছেন লাগেজ ছোড়াছুড়ির দৃশ্য। পেছন থেকে এক কর্মকর্তা এসে তাঁর মোবাইল কেড়ে নেন এবং তাঁকে ধাক্কা দেন। প্রবাসীর অপরাধ? তিনি অপরাধের প্রমাণ সংগ্রহ করছেন।
এই একটি ভিডিওই আবারও জনসম্মুখে উন্মোচন করলো একটি পুরনো, কুৎসিত সত্য-এই বিমানবন্দর চলছে একটি সংঘবদ্ধ ‘লুটেরা সিন্ডিকেট’-এর দখলে।
লাগেজ চুরি বা ভাঙচুরের হার কতটা ভয়াবহ?
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (CAAB)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে শাহজালালে প্রায় ৩,৫০০-এর বেশি লাগেজ চুরির অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে অনেকে অভিযোগ করতেই পারেন না, ভয়ে বা হতাশায়। প্রকৃত সংখ্যা হয়ত এর দ্বিগুণ।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি অপ্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রবাসীদের ৭২% তাদের অন্তত একবারের অভিজ্ঞতায় লাগেজ ভাঙা, খোলা বা হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ভুক্তভোগী হয়েছেন।
টার্মিনাল ১ ও ২-এর লাগেজ বেল্টের আশেপাশে ঘুরে বেড়ানো তথাকথিত ‘পোর্টার’ ও ‘হেলপার’দের অনেকেই আসলে সিন্ডিকেটের সদস্য, যারা লাগেজ বাছাই করে চুরি ও চাঁদাবাজির কাজে ব্যবহার করে।
সিন্ডিকেটের গঠন ও অপারেশনাল কাঠামো: কে কার সঙ্গে যুক্ত?
এই চোরাচালান-চাঁদাবাজি সিন্ডিকেট তিনটি স্তরে বিভক্ত:
১. বহির্ভূত ঠিকাদারি ও হ্যান্ডলিং কর্মীরা
এসব কর্মী বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিক কর্মচারী নন, কিন্তু ঘুষ দিয়ে তারা দীর্ঘদিনের ‘স্থায়ী শক্তি’। লাগেজ সনাক্ত ও সরবরাহের নামে যাত্রীদের মালপত্র খুলে দেখা হয়, চুরি করা হয়, কিংবা আদায় করা হয় উৎকোচ।
২. কাস্টমস ও নিরাপত্তা বাহিনীর ভিতরের কিছু সদস্য
কিছু অসৎ কাস্টমস কর্মকর্তা লাগেজ খুলে ফেলার সুযোগে ‘কেমিক্যাল’ বা ‘ইলেকট্রনিক্স’ আছে বলে জব্দ করে রাখেন। পরবর্তীতে চাঁদা নিয়ে তা ‘ফেরত’ দেন। ভিডিও করলে ভয় দেখান: “রুলিং আছে, ভিডিও নিষিদ্ধ।”
৩. রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও প্রশাসনিক সহনশীলতা
প্রভাবশালী রাজনৈতিক সংযোগের কারণে এই সিন্ডিকেট বহাল তবিয়তে চলছে। কয়েকজন সাংবাদিক অভিযোগ করেছেন, এই সিন্ডিকেটের পেছনে রয়েছে কিছু রাজনৈতিক নেতা, যারা কমিশনভিত্তিক সুবিধা পান।
প্রবাসীদের ‘টাকা পাঠাও, অপমান পাও’ নীতি কবে শেষ হবে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণ প্রায় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই রেমিটেন্স দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন। অথচ যাঁরা এই টাকা পাঠাচ্ছেন, তাঁরাই সবচেয়ে অবহেলিত ও অপমানিত।
বিমানবন্দরে তারা পান:
লাগেজ হারানোর ভয়
ঘুষ ছাড়া পাস না পাওয়া
অপমানজনক জিজ্ঞাসাবাদ
চুরি, ডাকাতি ও লাঞ্ছনার শিকার হওয়ার আশঙ্কা
প্রতিবাদ করলে সরকারি কর্মকর্তার হাতে শারীরিক নির্যাতন
জরুরি ভিত্তিতে কেন এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিমানবন্দর হচ্ছে একটি দেশের মুখ। যদি সেটি অপরাধের আখড়া হয়, তবে দেশের সম্মান রক্ষা করা যায় না। বিশেষত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়, যেখানে প্রশাসন ‘সংস্কার’ আর ‘উন্নয়ন’-এর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, সেখানে এ ধরনের অপরাধ সহ্যযোগ্য নয়।
প্রবাসী ও আমাদের দাবিসমূহ:
১. একটি উচ্চ পর্যায়ের স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করে ঘটনার পূর্ণ তদন্ত
২. বিমানবন্দর চেকিং এলাকায় ভিডিওগ্রাফি বৈধ ও উৎসাহিত করা
৩. সকল লাগেজ বেল্ট ও স্টোরেজে সর্বোচ্চ মানের সিসিটিভি সংযোজন ও জনসম্মুখে ফুটেজ প্রকাশ
৪. দোষীদের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি
৫. প্রবাসীদের জন্য স্বতন্ত্র অভিযোগ ও সহায়তা কেন্দ্র (ওন-স্পট)
৬. বিমানবন্দর দুর্নীতি রোধে ‘প্রবাসী ভিজিল্যান্স স্কোয়াড’ গঠন-যেখানে প্রবাসীরাই হবেন পর্যবেক্ষক
নির্বিশেষে আমাদের কথা: এই অপমান আর নয়!
এই রাষ্ট্র প্রবাসীদের রেমিটেন্স চায়, কিন্তু তাদের সম্মান দিতে চায় না। এটি এক গভীর নৈতিক পতন। এখনই সময় প্রবাসীদের অধিকার নিয়ে কথা বলার। এখনই সময় এসব ‘নির্লজ্জ লুটেরা’ কর্মকর্তাদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর।
শাহজালাল বিমানবন্দর কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়-এটি বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিষ্ঠান। এখানে চোর-ডাকাতের জায়গা হতে পারে না।
নবজাগরণ আজ এই ডাক দিচ্ছে-প্রবাসীদের অপমান নয়, সম্মান চাই।
লাগেজ ডাকাত সিন্ডিকেট ভাঙো, বাংলাদেশ বাঁচাও।





