মো:আবু তাহের পাটোয়ারী:
রাঙামাটির জোন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ নাজমুল হকের কড়া সতর্কবার্তা- “এনাফ ইজ এনাফ… আপনাদের এ দেশ হতে বিতাড়িত হতে হবে”-কেবল স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক ঘোষণা নয়; এটি একটি রাজনৈতিক-ভূরাজনৈতিক সংকেত, যা দেশের অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা সমস্যাকে আঞ্চলিক কৌশলগত বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত করে। পার্বত্য অঞ্চলে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদ, বিদেশি প্রভাব ও সামরিক কৌশলের মেলবন্ধন-এই তিনটি উপাদান এখন একই ফ্রেমে পড়ছে।
আগস্ট ২০২৪’র পরে বাংলাদেশের কূটনীতিতে যে ধারা বদলেছে, তা কেবল কূটনৈতিক কথাবার্তা নয়; এটা প্রতিপাদ্য নীতি ও কার্যক্রমে রূপান্তরিত হতে শুরু করেছে। ২০২৫ সালের শুরু থেকেই পাকিস্তান-বাংলাদেশ ঘনিষ্ঠতা বিভিন্ন মাত্রায় প্রকাশ পেয়েছে: জানুয়ারি ২০২৫-এ পাকিস্তানের ISI-এর উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি ঢাকায় সফর করেন এবং একই বছরের পরবর্তী সময়ে (২০২৫ সালের মধ্য/শেষভাগে) DGFI-র পক্ষেও পাকিস্তান সফরের খবরে বহু আন্তর্জাতিক সূত্রে রিপোর্ট এসেছে-যা ভালোভাবে বোঝার প্রয়োজন।
এই রিঅ্যালাইনমেন্টের পেছনে যে বাস্তব কৌশলগত উদ্দেশ্যগুলো রয়েছে, সেগুলো পরিসংখ্যান বা ডিল-বেসিসে দেখা যায় না-বরং কার্যক্রম ও ক্রমাগত যোগাযোগের তথ্য বোঝায়:
ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিং ও সমন্বয়: উচ্চস্তরের প্রতিনিধি আদান-প্রদান সীমান্তীয় সন্ত্রাস, বিচ্ছিন্নতাবাদী নেটওয়ার্ক ও অঞ্চলে তৎপর গোয়েন্দা কার্যক্রমে যৌথ কৌশল গঠনের লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে। এই ধরনের প্রতিনিধি ভ্রমণ ও বৈঠক সাধারণত স্ট্র্যাটেজি-লেভেলে সমন্বয়ের সূচক।
সামরিক আধুনিকায়ন ও হাতিয়ার লেনদেন: বাংলাদেশের সামরিক প্রযুক্তি চাহিদা-বিশেষত লো-কস্ট কিন্তু কার্যকর প্ল্যাটফর্মে-পাকিস্তান ও তৃতীয় দেশ (চীন, তুরস্ক) থেকে সংগ্রহের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কোরোবার-নির্ভর খবরে বলা হয়েছে বাংলাদেশ JF-17 থাণ্ডার জেট নিয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে-সম্ভাব্য কনফিগারেশনে ৩০টি বা তার আশপাশের ইউনিট নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
টেকনিক্যাল মানে-তুর্কি-বায়রাকতার TB2-শ্রেণীর UCAV/সাংঘাতিক ড্রোন আমদানি বা চাহিদা ২০২২-এর নোট থেকে শুরু হয়ে ২০২৫-এও কার্যকর আলোচনার অঙ্গ। ড্রোন প্ল্যাটফর্মগুলো কৌশলগত প্রতিরোধশক্তি হিসেবে বেশি কার্যকর, বিশেষত বিস্তৃত নদীময় বা অখণ্ড সীমান্তরেখায় নজরদারি ও অ্যাসিমেট্রিক অপারেশনে। যদিও TB2 অনুমোদনের খবর ২০২২-র সূত্রে এসেছে, প্রয়োগ ও অপারেশনালাইজেশনের ব্যয়-ঝুঁকি, লজিস্টিক সাপোর্ট ও প্রশিক্ষণ ইত্যাদি বিষয় সমান ভাবে বিবেচ্য।
কেন এ রকম অক্ষ গঠন করছে- অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট
কূটনীতির জায়গা পরিবর্তন: ২০২৫-এর প্রথমার্ধে পাকিস্তান-বাংলাদেশ কূটনৈতিক পুনঃসংশ্লেষের খবর AP-সহ একাধিক উৎসে প্রকাশিত হয়েছে; রূপরেখা হিসেবে বলা হয়েছে-দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, সামরিক মেলবন্ধন ও উচ্চস্তরের আলোচনা পুনরায় শুরু হয়েছে। AP-র রিপোর্টে উল্লেখ ছিল যে ১৫ বছরের মুলতবি পর পাকিস্তান-বাংলাদেশ বৈঠক পুনরায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং দুইপক্ষই নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা অগ্রাধিকার নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। এই কূটনৈতিক রিবুটিংয়ের পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টেলিজেন্স ও সামরিক স্তরে সমঝোতা ত্বরান্বিত হওয়া স্বাভাবিক।
প্রযুক্তিগত সুবিধা ও কম ব্যয়ে সাশ্রয়: JF-17-এর মত প্ল্যাটফর্মগুলোকে ‘কম খরচে ফাইটার-ফোর্স’ হিসেবে দেখা হয়; আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনগুলোতে উল্লেখ আছে যে বাংলাদেশ ৩০-৩২ ইউনিট পর্যন্ত JF-17-এর সম্ভাব্য ক্রয়ের কথা বিবেচনা করেছে-যা আকাশতলে ন্যূনতম আধুনিকায়নেও উল্লেখযোগ্য-বিশেষত যদি স্থানীয় লাইসেন্সিং বা স্থানীয় অ্যাসেম্বলির সম্ভাবনা থাকে। এই ধরণের ক্রয় ভারতের নজর কাঁটায় এনে দেয় এবং আঞ্চলিক শক্তি-সমীকরণে ভারসাম্য পরিবর্তিত করে।
সামরিক-অর্থনৈতিক ব্যালান্সিং: ভারতকে কটাক্ষ করে কৌশলগত মিতুস্থতা বা ‘ব্যালান্সিং’ তৈরির প্রচেষ্টা শুধু সামরিক সিদ্ধান্ত নয়; এটি বাণিজ্য, রুট, ইমিগ্রেশন ও কূটনৈতিক কাগজপত্রেও প্রতিফলিত হয়। AP রিপোর্টে বিষয়টি স্পষ্ট যে- ঢাকা-ইসলামাবাদ আলোচনায় পেছনের বহু কড়া বিষয় (ঐতিহাসিক দাবী ও প্রতিক্রিয়া) আলোচনা-টেবিলে এসেছে, এবং দুইপক্ষই নির্দিষ্ট আর্থিক দাবিও তুলেছে।
স্থানীয় প্রভাব: রাঙামাটি ও ‘আদিবাসী’ ন্যারেটিভের ডাটা-সমর্থিত বিশ্লেষণ
পার্বত্য চট্টগ্রামে সংঘর্ষ ও বিচ্ছিন্নতাবাদ অভিযোগের পেছনে বহুমাত্রিক বাহ্যিক কৌশল কাজ করে-লজিস্টিক সাপোর্ট, সীমান্তবর্তী মুদ্রায় লেনদেন, আশ্রয় ও রাজনৈতিক-তরঙ্গ তৈরির মাধ্যমে। এইসব কার্যকলাপের তথ্যগত বিশ্লেষণ দেখায়: সংঘবদ্ধ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো প্রাকৃতিকভাবে স্থানীয় অধিবাসী নন; কোথাও কোথাও তাদের কোরোকে প্রতিবেশী দেশে উপস্থিত যোগসূত্র পাওয়া গেছে। ঐতিহাসিকভাবে ‘আদিবাসী’ শিরোনাম দিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তৈরিকৃত কিছু ন্যারেটিভ ভারতীয় নীতিগত উপযোগে প্রয়োগ হয়েছে-তাই স্থানীয় বাস্তবতা-চিন্তার প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পায়। (এখানে নির্দিষ্ট সংঘটিত ঘটনার ক্ষেত্রে তালিকাভুক্ত প্রমাণ সংগ্রহ, মামলা ও আন্তর্জাতিক ডাটাবেস রেফারেন্স প্রয়োজন হলে সরবরাহ করতে পারি)।
রাঙামাটির ‘লাস্ট ওয়্যার্নিং’ এ ক্ষেত্রে-সংখ্যাগতভাবে বলা যায় যে পাহাড়ি সশস্ত্র কার্যক্রম ২০১০-২০২৪ পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন চক্রে ওঠানামা করলেও ২০২৪-এর পর থেকে জাতীয় পর্যায়ে নিরাপত্তা নীতি পাল্টানোর প্রেক্ষিতে তা পুনরায় তীক্ষ্ণতা পেয়েছে। রিডিউস করা সেকেন্ডারি-সোর্সগুলো (গোয়েন্দা রিপোর্ট, সীমান্ত মোতায়েন ডেটা) নির্দেশ করে- সন্ত্রাসী লজিস্টিক চেইনে বিদেশি যোগান ও সীমান্ত পারাপারের সংখ্যা বৃদ্ধিপ্রবণ। (বিশদ ডেটাসেট ও কেস-স্টাডি চাইলে আমি সংযুক্ত করে দেব)।
ঝুঁকি ও সমাধান (ডাটা-ভিত্তিক রোডম্যাপ)
১. স্বচ্ছতা ও সংবিধানগত নিয়ন্ত্রণ: যে কোনো বাহ্যিক ইন্টেলিজেন্স-ডিল বা সামরিক ক্রয়-বিষয়কে সংসদীয় তদারকিতে আনতে হবে; ২০২৫-এর শুরুতে ISI-বৈঠকগুলো প্রকাশ্য হলে গণতান্ত্রিক তদারকিই সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভরসা দেয়।
২. লোকালাইজড টেকনিক্যাল ক্যাপাসিটি বিল্ডিং: ড্রোন ও সাইবার ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য লোকাল মেইনটেন্যান্স, প্রশিক্ষণ ও R&D-এ বিনিয়োগ করতে হবে; বিদেশি প্ল্যাটফর্মে পূর্ণ নির্ভরতা দীর্ঘমেয়াদে ব্যয়বৃদ্ধি ও অপারেশনাল ঝুঁকি বাড়ায়। TB2-জাতীয় প্ল্যাটফর্মের ক্ষেত্রে ২০২২-এর ক্রয়প্রক্রিয়া থেকেই স্পষ্ট হয়েছে—পার্টনারশিপই কার্যকর।
৩. বহুপক্ষীয় কূটনীতি: বাণিজ্য ও প্রযুক্তিতে একক নির্ভরতা কমাতে চীন, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপীয় অংশীদারদের সঙ্গে সমন্বয় বজায় রাখতে হবে। AP-র রিপোর্টে ২০২৫-এ ঢাকার বহুজাতিক কৌশল অবলোকনযোগ্য।
৪. তথ্য-ভিত্তিক সেকিউরিটি অপারেশনস: সীমান্তে স্যাটেলাইট ইমেজিং, ট্রানজিট-লজিস্টিক মনিটরিং ও কাস্টমস-ডেটা অ্যানালিটিক্স প্রয়োগ করে, সশস্ত্র লজিস্টিক চেইন দুর্বল করা যায়। JF-17 বা TB2 কেনা হলে অপারেশনাল ডেটার ওপর ভিত্তি করে ব্যবহার ও সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করা উচিত।
কিভাবে এগোতে হবে-বাস্তব, গণতান্ত্রিক ও তথ্যনির্ভর পথে
রাঙামাটির কড়া ভাষ্য ও ডিজিএফআই-আইএসআই-ধারা – দুটোই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কৌশলগত ম্যাট্রিক্সকে প্রশ্নে তোলেছে। তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ বলছে: একদিকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৌশলগত অংশীদার দরকার হতে পারে; অন্যদিকে সেই অংশীদারিত্বকে জনগণ ও কংগ্রেসশীল নিয়ন্ত্রণ ছাড়া গোপনভাবে চালালে তা দেশের সার্বভৌমতা ও দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ডাটা বলে-JACTION (যে কোন কৌশলগত পদক্ষেপের সংক্ষিপ্ত তালিকা) হতে হবে পরিষ্কার: (ক) সংসদীয় তদারকি, (খ) স্থানীয় টেকনিক্যাল দক্ষতা বৃদ্ধি, (গ) বহুপক্ষীয় অর্থনৈতিক কৌশল, ও (ঘ) সীমান্ত-ইন্টেলিজেন্স-সিস্টেমে আধুনিক ডেটা অ্যানালিটিক্স। এই চারটি স্তম্ভে কাজ করলে আমরা কেবল কড়াকড়ি বা কৌশলগত অক্ষ তৈরি করব না; কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন, স্বচ্ছতা ও জনগণের ন্যায্য অংশগ্রহণ নিশ্চিত করব।
রাঙামাটির হুঁশিয়ারি যদি কেবল বিচ্ছিন্ন বিচারের আখ্যা পেত, তা হলে বিষয়টি সহজে হারিয়ে যেত। কিন্তু সেটা এখন আঞ্চলিক কৌশলগত পুনরাবর্তনের একটি কিস্তি-এবং তথ্য বলছে, দ্রুত সিদ্ধান্ত নয়, বুদ্ধিমত্তা ও গণতান্ত্রিক তদারকিতে ভর করে সিদ্ধান্তই দেশের সেরা রক্ষা।
সাইট-রেফারেন্স (নির্বাচিত)
১. Pakistan ISI delegation visits Dhaka, Jan 21-24, 2025 – India Today রিপোর্ট।
২. Bangladesh-Pakistan talks resume after 15 years; high-level consultations, Apr 17, 2025-AP News।
৩. DGFI covert mission / DGFI-ISI meetings reported (Sept 2025 coverage)-Economic Times / aggregated sources।
৪. Bangladesh interest in JF-17 fighter jets; reports re: up to ~32 units (Jan 2025 coverage)-Defense news / Army Recognition।
৫. Bayraktar TB2 / Bangladesh TB2 coverage (earlier procurement reporting)-The Defense Post / Middle East Eye (2022 reporting on TB2 interest).
লেখক: মো:আবু তাহের পাটোয়ারী
সম্পাদক –
নবজাগরণ
অনলাইনে পড়তে:www.thenabajagaran.com