বিশেষ প্রতিবেদক : গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতার বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধু পরিষদের মনোনয়ন নিয়ে পুরো প্রকৌশলী প্যানেলকে কলংকিত করেছেন। ২০২১ সালে বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের সভায় পরবর্তী আইইবি নির্বাচনে শামীম আখতার এর মনোনয়নের সিদ্ধান্ত ছিল একটি রাজনৈতিক তদবিরের সূচনা, আর কতোদিন এই একটি সিদ্ধান্তের উত্তরাধিকার শামীম আখতার কে টেনে চলবে বর্তমান প্রজন্ম ? এ প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে। গণপূর্ত অধিদপ্তরের বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার যেন এক ধনকুবের মুকেশ আম্বানির উত্তরসূরী। মুখে দাড়ি আর গায়ে বড় জুব্বা পড়ে সিষ্টেম করে ঘুষ গ্ৰহণ করতেন। সরকারী সকল প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে তাকে শতকরা দুই পার্সেন্ট ঘুষ না দিলে ফাইল গতিশীল হতো না। যদিও সে মাজার পুজারি ছিল। ৫ই আগষ্টের পর তার বস্তা বস্তা টাকা নারায়ণগঞ্জের এক মাজারে গচ্ছিত ছিল। তার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত উপদেষ্টাকে মোটা অংকের ঘুষের বিনিময়ে এখনো বহাল তবিয়তে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে গণপূর্তে বহাল তবিয়তে আছে।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতারের উত্থান কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়—এটি ছিল একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ফল। ২০২১ সালে “বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদ” এর এক সভাতেই শুরু হয়েছিল এই উত্থানের কাহিনি।
সেই সভায় উপস্থিত নেতৃবৃন্দ ২০২৩ সালের আইইবি নির্বাচনে শামীম আখতার কে তাদের প্যানেল থেকে মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সভা শেষে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. নুরুজ্জামান স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষণা করা হয়—
মোহাম্মদ শামীম আখতার ছাত্রজীবনে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বুয়েট শাখায় সক্রিয় ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের পরবর্তী নির্বাচনে উপযুক্ত পদে তার মনোনয়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।”
এই ঘোষণাটিই ছিলো মূলত গণপূর্তে একটি রাজনৈতিক লবির জন্মকথা। যেই লবি নিজেদের পেশাজীবী পরিচয়টি আড়ালে রেখে দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনের ভেতরে ‘আওয়ামী প্রভাব’ বিস্তার করে প্রশাসনকে জনগণের প্রশাসন থেকে আওয়ামী প্রশাসনে রুপান্তরিত করেছে। এবং এই আওয়ামী প্রশাসন এর প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে শেখ হাসিনা জননেত্রী থেকে ফ্যাসিবাদের নেত্রীতে পরিনত হয়েছিলেন।
রাজনৈতিক ছায়ায় পেশাগত উত্থান : গণপূর্তে শামীম আখতার নামটি এখন পরিচিত একটি সিন্ডিকেটের প্রতীক হিসেবে। তিনি ছিলেন ছাত্রলীগ পটভূমির মানুষ এ নিয়ে তার অহঙ্কার প্রকাশ্যেই দেখা গেছে। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতেই তার রাজনৈতিক শিকড় স্পষ্ট করা হয়েছিল, যেখানে বলা হয়েছিল, শামীম আখতারের পরিবার রাজশাহীর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের পরিবারের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত। অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের নির্বাচনে বাঘা আসনে শাহরিয়ার আলমের প্রচারণায় শামীম আখতারের পরিবারের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। সেই রাজনৈতিক আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে পরবর্তীতে গণপূর্তে তার পদোন্নতি, পদায়ন ও সিদ্ধান্তগুলোতে বিশেষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন ১৫ ব্যাচের ছয়জন সিনিয়র প্রকৌশলীকে উপেক্ষা করে তাকে প্রধান প্রকৌশলী করা হয়, তখনই অনেকে বলেছিলেন—“এটি বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের পুরনো সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন মাত্র।”
২০২৫: পতনের পরেও প্রভাব অটুট : স্বৈরাচারী শাসনের পতনের পরও সিন্ডিকেটের প্রভাব কমেনি—বরং আরও চতুরভাবে ছায়া বিস্তার করেছে। শামীম আখতার এখন দৃশ্যত পদে নেই, কিন্তু তার ঘনিষ্ঠ নির্বাহী প্রকৌশলীরা আজও দেশের বিভিন্ন বিভাগে কার্যত নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছেন। তারা নিজেদের “বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের সৈনিক” বলে পরিচয় দেন, যা নতুন প্রশাসনের জন্যও এক ধরনের অঘোষিত হুমকি। অধিদপ্তরের অভ্যন্তরে এখন প্রশ্ন একটাই— ২০২১ সালের সেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ছায়া কি আজও গণপূর্তের পেশাদারিত্বকে গ্রাস করে রেখেছে?
সিন্ডিকেটের উত্তরাধিকার : একসময় “আদর্শ পেশাজীবী সংগঠন” হিসেবে পরিচিত বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদ আজ পরিণত হয়েছে “স্বৈরাচারের দোসর” নামের কুখ্যাত এক গোষ্ঠীতে। ২০২১ সালের সেই প্রেস বিজ্ঞপ্তিটি আজ ইতিহাসের অকাট্য দলিল—যা প্রমাণ করে, রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে গঠিত এক সিদ্ধান্ত কেবল পেশাগত প্রতিষ্ঠানকেই নয়, বরং গোটা অধিদপ্তরেরই নৈতিক ভিত্তিকে ধ্বংস করে দিতে পারে।
গণপূর্ত এখন প্রশ্নবিদ্ধ— রাজনীতি মুক্ত পেশাজীবী সংগঠন কবে ফিরবে? আর কতদিন “বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদ”-এর সিদ্ধান্তের উত্তরাধিকার টেনে চলবে বর্তমান প্রজন্ম? গণপূর্ত অধিদপ্তরকে কলংক মুক্ত করতে শামীম আখতারের মতো ফ্যাসিস্টদের দোসরদের অপসারণ করা একান্ত প্রয়োজন। তাদের ঘুষ বাণিজ্য ও অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থের তদন্ত করে দুদকের কার্যক্রম অব্যাহত রাখলে শামীম আখতার প্রধান অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হবে এবং গণপূর্ত অধিদপ্তর কলুষমুক্ত হতো।